ভূমিকম্পের দুই দিন অতিবাহিত হলেও মানুষের মাঝে আতঙ্ক কাটেনি। এখনো নরসিংদীর পলাশ উপজেলার বাসিন্দারা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর থেকেই এলাকাজুড়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই ঘরবাড়ির দেওয়ালে ফাটল দেখা দেওয়ায় রাতে ঘুমাতে গেলেও মনে ভর করছে নতুন করে আরেকটি কম্পন আঘাত হানার ভয়।
ভূমিকম্পের পর বেশ কয়েকবার ‘আফটারশক’ অনুভূত হওয়ায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা সবচেয়ে বেশি ভীত হয়ে পড়েছেন। কম্পনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ছোটদের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। অনেক শিশু এখন স্বাভাবিক আচরণে ফিরতে পারছে না, একা একা খেলতে কিংবা বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছে, সামান্য শব্দেই চমকে উঠছে, কেউ কেউ স্কুলেও যেতে চাইছে না।
ঘোড়াশালের দক্ষিণ চরপাড়ার বাসিন্দা ছামিউল হক বলেন, ‘আমার নয় বছরের ছেলেটা ভূমিকম্পের পর থেকে খুব ভীত হয়ে গেছে। রাতে বিছানা নড়ছে মনে করে কাঁদতে শুরু করে। বাইরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। স্কুলে যেতে চাচ্ছে না।’
সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক বিরাজ করছে ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র আবাসিক ভবনে। আবাসিক এলাকার একাধিক ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কিছু যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়েছে, আগুনও ধরে যায়।
গতকাল রোববার বিকালে আবাসিক ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেগুলো ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। বহুতল ভবনে বসবাসকারী অনেক পরিবার নিরাপত্তার জন্য খোলা মাঠে, সিঁড়ির কাছে বা নিচতলায় সময় কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
পলাশ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও স্থানীয় বাসিন্দা বরুন চন্দ দাস বলেন, ‘ভূমিকম্পের দিন যেভাবে পুরো বাসাটা দুলছিল, সেটা ভুলতে পারছি না। এখনো রাতে ঘুমাতে ভয় লাগে। সামান্য শব্দ হলেই মনে হয় আবার কম্পন শুরু হলো। আমার বয়সে এত বড় ভূমিকম্প দেখিনি।’
পৌর এলাকার বাসিন্দা আফজাল হোসেন বলেন, ‘আমাদের বাড়ির দেওয়ালে ছোটখাটো ফাটল দেখা দিয়েছে। বাচ্চাদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। দুই দিন হয়ে গেছে, কিন্তু মনটা শান্ত হচ্ছে না।’
সরজমিনে দেখা যায়, শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর পুরোনো রেলসেতুতে ফাটল দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া ঘোড়াশাল সরকারি খাদ্যগুদামের ভবন, ঘোড়াশাল মুসাবিন হাকিম ডিগ্রি কলেজ ভবন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্কুল ভবন, ঘোড়াশাল বাজারের এস.এ শপিং মল, ইতালি আবাসিক ভবন, সুন্নাহ তাহফিজুল কোরআন মাদ্রাসা সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দোকানে ভূমিকম্পে ব্যাপক ফাটল দেখা যায়।
আতঙ্কিত ছিলেন জনতা জুট মিল, ওমেরা পেট্রোলিয়াম ফ্যাক্টরি, স্যামরি ডাইং ফ্যাক্টরি ও প্রাণ-আরএফএল কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরাও। কম্পনের সময় দৌড়াদৌড়ি করে কয়েকজন আহতও হন।
এদিকে, ভয়াবহ ভূমিকম্পে নরসিংদীর ঘোড়াশাল ডেইরি ফার্ম ও পলাশ রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে ধসে পড়া মাটির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ। গুগল ম্যাপ অনুযায়ী, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা গ্রাম—শীতলক্ষ্যা নদীর পাশে। এই স্থানটি ঘোড়াশাল পৌর শহরের কাছাকাছি হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়েছে।
উপজেলায় ভূমিকম্পের সময় মাটির ঘরের দেয়াল চাপায় চরসিন্দুর ইউনিয়নের মালিতা পশ্চিমপাড়া গ্রামের বাসিন্দা কাজম আলী (৭৫) এবং ধানখেত থেকে দৌড়ে বাড়ি ফেরার পথে গর্তে পড়ে স্ট্রোক করে ডাঙ্গা ইউনিয়নের কাজীরচর গ্রামের মো. নাসির উদ্দীন (৬৫) নামে দুই বৃদ্ধ নিহত হন।
পলাশ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) কাউছার আলম সরকার জানান, পলাশ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত শতাধিক মাটির ঘর এবং অর্ধশতাধিক সরকারি-বেসরকারি ভবনে ফাটল ও ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে সংখ্যাটি আরও বাড়বে বলে তিনি জানান। ভূমিকম্পে নিহত দুই পরিবারের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক অনুদান এবং কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্তকে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
পলাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবুবক্কর সিদ্দিকী বলেন, ‘পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত জনগণকে সচেতন ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। জরুরি প্রয়োজনে সহায়তা দিতে প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবক দল প্রস্তুত রয়েছে।’
তিনি আরও জানান, প্রায় ৫০টির বেশি ভবন আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত নিরূপণের কাজ চলছে।




সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন