ঢাকা রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫

দলীয় সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে হাসপাতাল, ভোগান্তিতে সাধারণ রোগী

রেজাউল করিম মানিক, রংপুর
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৪, ০৮:০৯ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

রংপুর: লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সেবার মান, খাবার, পরিবেশসহ নানান অসুবিধায় চিকিৎসা সেবা থেকে দীর্ঘ দিন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। চিকিৎসকদের স্বেচ্ছাচারিতা, ব্যাক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখার প্রবণতায় ক্ষোভে ফুসছে চিকিৎসা নিতে আসা ভুক্তভোগি রোগীরা। সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে অনেকেই ধাবিত হচ্ছেন রংপুরের দিকে। আওয়ামী লীগ দলীয় বলয়ে থেকে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক হাসপাতালে সিন্ডিকেট করে নিজেদের খাম খেয়ালী মত চালাচ্ছেন সকল কার্যক্রম। এতে একদিকে যেমন ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবার মান অপরদিকে সাধারণ রোগীদের পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি।

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি ব্যাক্তিগত ক্লিনিক খুলে রোগীদের কৌশলে সেখানে চিকিৎসা নিতে প্রভাবিত করছেন। হাসপাতালে পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বাইরে নিজের ক্লিনিকে পরীক্ষা করাতে বাধ্য করছেন রোগীদের। এতে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, দুই লক্ষাধিকেরও বেশি মানুষের চিকিৎসার একমাত্র স্থান হাতিবান্ধা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নানান অসঙ্গতি ও অনিয়ম। বহির্বিভাগে শত মানুষ অপেক্ষা করছে ডাক্তার দেখানোর জন্য। অন্ত:বিভাগেও ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪০/৫০ জন রোগী। অনেকেই আসছেন ডাক্তার দেখাচ্ছেন পরে চলে যাচ্ছেন কথা হয় সেবা নিতে আসা রোগীদের সঙ্গে, তাদের অভিযোগ, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে তেমন তৎপরতা নেই এখানে। ঠিকমতো সেবা না পাওয়ার নানান অভিযোগ তাদের। আগে থেকেই আওয়ামী লীগ দলীয় প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতালের খাবার, টেন্ডার সহ সব নিয়ন্ত্রণ করা হতো। এখনো সেই সিন্ডিকেটের পরোক্ষভাবে ভাবে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। দ্রুত সিন্ডিকেট ভেঙ্গে হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবার মান ফিরিয়ে আনার দাবী স্থানীয়দের।

এসব প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আনোয়ারুল ইসলাম গড়ে তুলেছেন একটি শক্তিশালী চিকিৎসা সিন্ডিকেট। স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেনের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে হাতিবান্ধা এলাকায় বহুতল ভবন জুড়ে গড়ে তুলেছেন মায়ের নামে আলেয়া জেনারেল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক নামক প্রাইভেট হাসপাতাল। পরিবেশ অধিদপ্তরের সার্টিফিকেট সহ কোন ধরনের অনুমোদন না নিয়েই চলছে কার্যক্রম। অনভিজ্ঞ ব্যক্তি দিয়ে বিভিন্ন টেস্টের নামে সাধারণ মানুষের পকেট কাটছেন। আবাসিক মেডিকেল অফিসার হওয়ার সুবাধে হাতিবান্ধা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সকল রোগীদের বিভিন্ন কৌশলে তার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। নিজের স্ত্রী সহ ওই ক্লিনিকে রোগী দেখেন আবাসিক চিকিৎসক
আনোয়ারুল। এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ব্যাক্তিদের বাইরে তার ক্লিনিক থেকে সকল টেস্টের জন্য পাঠানো হয়। সকল টেস্টে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমিশন দেন তিনি। এমনকি হাসপাতালে যে টেস্টের ব্যবস্থা আছে সেটাই অনেকেরই রয়েছে জানার বাইরে। প্রভাবশালী সিন্ডিকেট হওয়ায় দেশ সংস্কারের সময়ও এটা নিয়ে কেউ মুখ খুলছেনা।

সরেজমিনে আরও দেখা যায়, হাসপাতালটির ল্যাবে ১৭ ধরনের বিভিন্ন টেস্ট এর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু রোগীদের কৌশলে বাইরের ডায়াগনস্টিক এ পাঠানো হচ্ছে টেস্ট এর জন্য। বিশেষ ছাড়ের সিল বা স্বাক্ষর করায় ডায়াগনস্টিক ছুটে যাচ্ছেন রোগী ও রোগীর স্বজনরা। খোজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন টেস্ট মিলিয়ে বাইরের ডায়াগনস্টিক এ অতিরিক্ত ভাউচার করে ডাক্তারের দেওয়া ছাড় দেখিয়ে স্বাভাবিক এর চেয়েও বেশি দাম নির্ধারণ করা হয়। সাধারণ মানুষ এসব টেস্টের মূল্য না জানায় এভাবে প্রতিনিয়ত ঠকছেন। হাসপাতালের ল্যাবে যে সকল টেস্ট হয় কোনদিন একজনকেও পাওয়া যায়না। ল্যাব সূত্র বলছে, জুলাই মাসে এই ল্যাবে টেস্ট
হয়েছে ৫০ টি, জুনে ৬৩ টি, মে মাসে ৫০ টি যেখানে গড়ে প্রতিদিন বহি:বিভাগ ও অন্তবিভাগে ১০০ এরও বেশি লোক চিকিৎসা নিতে আসেন।

হাসপাতাল সূত্র বলছে, ১০ আগস্ট অন্ত:বিভাগে রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন ২৬ জন,১১ আগস্ট ৫৯ জন, ১২ আগস্ট ৫০ জন, ১৩ আগস্ট ৪৬ জন, ১৪ আগস্ট ৪২, ১৫ আগস্ট ৪৫ জন, ১৬ আগস্ট ৫০ জন, ১৭ আগস্ট ৫৩ জন, ১৮ আগস্ট ৪৬ জন ও ১৯ আগস্ট ৪৫ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। 

এছাড়াও বহি:বিভাগ সূত্র বলছে, গড়ে বিভিন্ন চিকিৎসক এর চেম্বারে নারী, পুরুষ শিশু সহ নানান রোগী ৭০/৮০ জন চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। তাহলে এতসব রোগীর টেস্ট হয় কোথায়? হাতিবান্ধা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ল্যাব টেকনিশিয়ান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ব্লাড টেস্ট, ইউরিন টেস্ট, প্রেগন্যান্সি, ডেঙ্গু, এমএস১, আইজিজি সহ ১৭ ধরনের টেস্ট হয়ে থাকে। দিনে ১/২ জন টেস্টের জন্য আসে, কোনদিন কাউকেও পাওয়া যায়না। বাইরে এত রোগী কিন্তু টেস্টের হার কেন কম? এমন প্রশ্নের জবাব তিনি জানেননা বলে জানান। তিনি বলেন, এখানে যারা আসে আমরা টেস্ট করাই।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নারীর অভিযোগ, ভর্তি হওয়ার পর বাইরে থেকে দুই হাজার টাকার টেস্ট করাতে বলছে। গরীব মানুষ হয়ে তার এই টেস্ট করাটাও দুরহ। হাসপাতালে টেস্ট হয় সেটাও তার জানা নাই বা কেউ বলেনাই। ডাক্তার বাইরে থেকে টেস্ট করিয়ে আনতে বলছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই এলাকার স্কুল শিক্ষক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মোতাহার এমপি ও আওয়ামী লীগের সভাপতি লিয়াকত হোসেন বাচ্চুর নির্দেশে হাসপাতালের সকল সিন্ডিকেট চলতো। এখনো অনেকটা ওইভাবেই চলছে। কেউ তো আর প্রতিবাদও করছেনা। ডাক্তাররা যতটা না সেবা দিয়েছে তার থেকে বেশি নেতাদের পিছনে ঘুরেছে। তাদের মন জয় করে চেম্বার/ক্লিনিকে রোগী দেখে বিপুল অর্থ কামিয়েছেন।

হাতিবান্ধা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সদস্য মহসিন মিয়া বলেন, হাতিবান্ধা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স টিতে সেবার মান অনেকটা নস্ট হয়ে গেছে। ফ্রি ঔষধ রোগিরা পাননা, প্যাথলজিক্যাল সাপোর্ট ঠিকমতো পায়না রোগিরা, ডাক্তাররা চেম্বারে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন রোগী দেখতে এমন নানান অভিযোগ আসছে। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। পট পরিবর্তনে আশা করি এখানে সংস্কার আসবে। আমরা অতি দ্রুত হাসপাতালে গিয়ে অনিয়ম দুর্নীর প্রতিবাদ জানাবো।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত আবাসিক চিকিৎসক ডা. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ওই ক্লিনিক তার মামার। তার কোন মালিকানা নাই। তবে তিনি সেখানে বসেন এবং তার মালিকানার যথাযথ প্রমাণ দিতে চাইলে তিনি যথাযথ উত্তর দিতে পারেননি। অনুমোদন না নিয়েই কেন ক্লিনিক চলছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে বলে জানান। হাসপাতালে সরকারি ভাবে ন্যায্য মূল্যে টেস্ট করানোর সুযোগ থাকলে তা কেন হচ্ছে না এর কোন সদুত্তর তিনি দিতে পারেন নাই।

সার্বিক বিষয়ে লালমনিরহাট জেলা সিভিল সার্জন নির্মলেন্দু রায় বলেন, জেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গুলোতে চিকিৎসক সংকটে সেবা ব্যাহত হচ্ছে অনেকটা। হাতিবান্ধার আবাসিক চিকিৎসক আনোয়ারুল ইসলাম অনুমোদন না নিয়েই ক্লিনিক চালাচ্ছেন আমিও শুনেছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।