‘আশা করি মৃত্যুটা আনন্দের হবে, আমি আর কখনোই ফিরে আসার প্রত্যাশা করি না।’- মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর হয়ে উচ্চারিত ফ্রিদা কাহলোর এই বাক্যটিই বলে দেয়, কতটা রক্তক্ষরণ, কতটা ধ্বংস আর কতটা অদমনীয় জীবনচর্চার সাক্ষী ছিলেন তিনি।
নারীর শিল্পচর্চা নতুন নয়। প্রাচীনকাল থেকে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নারীরা শিল্পে নিজেদের প্রকাশের পথ তৈরি করেছেন। কিন্তু স্বীকৃতি পাওয়ার রাস্তা সবসময়ই সহজ ছিল না। বিংশ শতাব্দীতে এসে নারীরা আরও স্পষ্টভাবে নিজেদের অভিজ্ঞতা, অনুভব ও প্রতিবাদ শিল্পের ভাষায় বলার সাহস পেলেন। সেই সাহসী নারীদের কাতারে ফ্রিদা কাহলো একটি উজ্জ্বল নাম।
১৯০৭ সালের ৬ জুলাই মেক্সিকোতে জন্ম নেওয়া ফ্রিদার জন্মনিবন্ধনে লেখা থাকলেও তিনি নিজে জন্ম তারিখ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ১৯১০ সাল- মেক্সিকান বিপ্লবের বছর। সম্ভবত তার জীবনের সঙ্গে বিপ্লব শব্দটির এত গভীর সম্পর্ক ছিল বলেই। মাত্র ছয় বছর বয়সে পোলিও রোগে আক্রান্ত হন তিনি। এরপর ১৮ বছর বয়সে এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা তার শরীরকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। মেরুদণ্ডে রড ঢুকে যায়, শরীরের একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়। প্রায় ৩০টির বেশি অস্ত্রোপচার তাকে সহ্য করতে হয়। কিন্তু এই সীমাহীন যন্ত্রণার মাঝেও শিল্পই হয়ে ওঠে তার বেঁচে থাকার উপায়।
শিল্প ও যন্ত্রণা
ফ্রিদার শিল্পকর্মে সবচেয়ে বেশি উঠে আসে তার নিজের জীবন। আত্মপ্রতিকৃতি তার প্রধান মাধ্যম। তার পেইন্টিংগুলো যেন নীরব চিৎকার, ভেতরের ক্ষতচিহ্নের বহিঃপ্রকাশ। ভালোবাসা, গর্ভপাত, বন্ধ্যাত্ব, বিচ্ছেদ, রাজনৈতিক বিশ্বাস- সবই স্থান পায় তার ছবিতে। পরাবাস্তববাদীরা তাকে নিজেদের একজন মনে করলেও ফ্রিদা কখনো বলেননি তিনি স্বপ্ন আঁকেন; বরং তিনি আঁকতেন বাস্তব, যেটি কখনো কখনো স্বপ্নের চেয়েও ভয়াবহ।
এক জীবন, এক সংগ্রাম
স্বামী দিয়েগো রিভেরার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ভালোবাসা, বিশ্বাসঘাতকতা ও শিল্পের এক মিশ্র রসায়ন। ফ্রিদা নিজেই বলেছিলেন, তার জীবনে দুটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে- একটি বাস দুর্ঘটনা, আরেকটি দিয়েগো। অথচ দিয়েগোই ছিলেন তার ভালোবাসার প্রতীক এবং ভাঙনের যন্ত্রণা।
শারীরিকভাবে সন্তান ধারণে অক্ষম হওয়ায় বারবার গর্ভপাতের যন্ত্রণাও তাকে ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু কোথাও এক বিন্দু দুর্বলতা নয়- বরং তার আত্মপ্রতিকৃতি হয়ে উঠেছে এসব যন্ত্রণার সাক্ষ্য বহনকারী শক্তি। জড়জীবন, ফলমূল, অঙ্গচ্ছেদের রূপক দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন পরাবাস্তববাদী অথচ ভয়াবহভাবে বাস্তব এক চিত্রজগৎ।
শিল্পের গ্যালারিতে এক জীবন্ত প্রতিবাদ
ছাত্রজীবনে লেখাপড়া করে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু দুর্ঘটনার পর সেই স্বপ্ন মুছে যায়। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই আঁকা শুরু করেন, বলেন- ‘আমি এখনো অনেক শক্তি অনুভব করি কিছু করার, তবে চিকিৎসক হওয়ার মতো নয়। তাই আমি আঁকতে শুরু করি...’
ফ্রিদার প্রথম একক প্রদর্শনী হয় নিউইয়র্কে ১৯৩৮ সালে। মৃত্যুর আগের বছর- ১৯৫৩ সালে মেক্সিকোতেই হয় তার প্রথম দেশীয় একক প্রদর্শনী। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ফ্রিদা জীবদ্দশায় যতটা না খ্যাতি পেয়েছিলেন, মৃত্যুর পরে তিনি হয়ে ওঠেন এক কিংবদন্তি।
২০০৫ সালে লন্ডনের টেট মর্ডান গ্যালারিতে ফ্রিদা কাহলোর একক প্রদর্শনী হয়। এটি ছিল তার মৃত্যুর পরে আয়োজিত অন্যতম বৃহৎ প্রদর্শনী। সেখানে ছিল তার আঁকা আত্মপ্রতিকৃতি, জড়জীবনের সিরিজ, ডায়েরির পাতা থেকে নেওয়া স্কেচসহ বহু দৃষ্টিনন্দন চিত্রকর্ম। শিল্প সমালোচক আঁন্দ্রে ব্রেতোঁ একবার ফ্রিদাকে আখ্যা দিয়েছিলেন- ‘ফিতায় মোড়ানো বোমা’।
জীবনের শেষ ও অনন্ত অনুপ্রেরণা
১৯৫৪ সালের ১৩ জুলাই, জন্মদিনের ঠিক এক সপ্তাহ পরে, ব্লু হাউসেই মৃত্যুবরণ করেন ফ্রিদা। সেখানেই কেটেছে তার শৈশব, যৌবন, প্রেম ও সংগ্রাম। তার মৃত্যুর তিন বছর পর ১৯৫৭ সালে মারা যান দিয়েগো রিভেরা। ১৯৫৮ সালে ব্লু হাউসকে রূপান্তর করা হয় ফ্রিদা কাহলো মিউজিয়ামে।
শিল্পী হওয়া তার নিয়তিই ছিল। ফ্রিদা আজ শুধুমাত্র এক চিত্রশিল্পী নন, তিনি এক প্রতীক- যন্ত্রণাকে রঙে রূপান্তর করার প্রতীক। নারীর যন্ত্রণাকে সাহসিকতার সঙ্গে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করার প্রতীক। নিজের জীবনের ভয়াবহতম সত্যগুলোকে নির্মোহভাবে তুলে ধরার অদ্বিতীয় সাহসের জন্য তিনি আজীবন থাকবেন শিল্প ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসী নারীদের একজন হিসেবে।