নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান, তবে তিনি আমাদের কাছে অধিক পরিচিত এস. এম. সুলতান নামে। ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট, নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বাংলার এই কৃতি সন্তান। পারিবারিক ডাক নাম ছিল ‘লাল মিয়া’। পিতার নাম শেখ মোহাম্মদ মেসের আলী, যিনি মূলত কৃষক হলেও জীবিকা নির্বাহে রাজমিস্ত্রির কাজও করতেন।
মাত্র ১০ বছর বয়সে, ১৯৩৩ সালে, স্কুল পরিদর্শনে আসা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির একটি পেন্সিল স্কেচ এঁকে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। সেই একটি ছবি দিয়েই শিল্পী হিসেবে সুলতানের প্রথম আত্মপ্রকাশ।
তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে এগিয়ে আসেন স্থানীয় জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় এবং তার ভাইপো অরুণ রায়, যিনি ছিলেন কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র। অরুণ রায়ের হাতে চলতে থাকে সুলতানের ছবি আঁকার অনুশীলন।
সুলতান কখনোই প্রথাগত শিক্ষায় আগ্রহী ছিলেন না। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েই তিনি স্কুল জীবন থেকে সরে আসেন। তবে শিল্পের প্রতি তার আগ্রহ ও ভালোবাসা বরাবরই অদম্য ছিল।
১৯৪১ সালে শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সহায়তায় কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং ভর্তি পরীক্ষায় ৪০০ জনের মধ্যে প্রথম হন। যদিও তিন বছর পরই তিনি সেই শিক্ষার পথ ছেড়ে দেন। কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও যান্ত্রিক নিয়মের সঙ্গে তার স্বাধীনচেতা ও ভবঘুরে মন মানিয়ে নিতে পারেনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি দেশজুড়ে ঘুরে ঘুরে ছবি আঁকতেন এবং ব্রিটিশ ও আমেরিকান সেনাদের কাছে তা বিক্রি করতেন। তার প্রথম প্রদর্শনী হয় ১৯৪৭ সালে শিমলায়, এরপর লাহোর ও করাচিতে।
১৯৫০ সালে আমেরিকার আমন্ত্রণে যান আন্তর্জাতিক শিল্প সম্মেলনে। নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, লন্ডনের গ্যালারিগুলোতে তার চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয় পিকাসো, দালি প্রমুখের শিল্পকর্মের পাশে। তার প্রতিভা বিশ্বমঞ্চে প্রশংসিত হলেও, তিনি এসব খ্যাতিকে কখনোই মূল্য দিতেন না।
১৯৫৩ সালে তিনি সব কিছুকে পাশ কাটিয়ে ফিরে আসেন নিজ জন্মস্থান নড়াইলে। এখানেই তিনি গড়ে তোলেন ‘নন্দন কানন’ নামে শিশুদের জন্য স্কুল, আর্ট স্কুল ও পরে ‘শিশুস্বর্গ’ ও ‘চারুপীঠ’ নামে প্রতিষ্ঠান। শিশুদের নিয়ে ছিল তার অফুরন্ত স্বপ্ন।
তিনি বিশ্বাস করতেন- যে শিশু প্রকৃতিকে ভালোবাসে, গাছ, পশুপাখি, গ্রামের দৃশ্য আঁকে, সে কোনোদিন অপরাধী হতে পারে না।
সুলতানের ছবিতে ফুটে উঠেছে এক অনন্য গ্রামীণ বাংলাদেশ। তার তুলিতে উঠে এসেছে পেশিবহুল, বলিষ্ঠ কৃষক; সুঠাম গড়নের কৃষাণী। হয়তো বাস্তবে তারা ছিল রুগ্ন, শোষিত; কিন্তু সুলতান কল্পনায় গড়েছেন শক্তিশালী এক কৃষক সমাজ।
তার ছবি শুধু রূপ নয়, প্রতিবাদেরও ভাষা। ‘হত্যাযজ্ঞ’ (১৯৮৭), ‘চরদখল’ (১৯৮৮)- এসব ছবিতে উঠে এসেছে সমাজের শ্রেণি বৈষম্য, শোষণ ও গ্রামীণ জীবনের কঠিন বাস্তবতা।
সুলতান ছিলেন আত্মদর্শী। ইউরোপকেন্দ্রিক, নগরনির্ভর, যান্ত্রিক আধুনিকতার বিপরীতে তিনি দাঁড় করিয়েছেন ‘মানবিক আধুনিকতা’। শিল্পের সংজ্ঞাকে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতির বাইরে নিয়ে গেছেন। রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো তিনি মানবকর্মের মাঝে খুঁজেছেন সৌন্দর্য ও চিরন্তনতার ছোঁয়া। ফর্মের নিরীক্ষাকে নয়, মানুষের ভেতরের শক্তিকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন।
নড়াইলের পুরুলিয়ায় নিজ পৈতৃক ভিটায় কাটিয়েছেন জীবনের শেষ দিনগুলো। চিত্রা নদীর পাড়ে গড়ে তুলেছিলেন এক স্বপ্নের জগৎ। বাড়িতে ছিল চিড়িয়াখানা, শিশুদের জন্য বিশাল কাঠের নৌকা, ছিল পোষা বিড়াল, আর ছিল অগণিত আশ্রয়প্রার্থী মানুষ- যাদের জন্য তিনি নিজের ঘরও ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাঁশি বাজাতেন, শাড়ি পরে নাচতেন, তবলা বাজাতেন- এইসবই ছিল তার জীবনের একান্ত আনন্দ।
বিশ্বজুড়ে নানা সম্মাননা পেলেও তিনি বলতেন, ‘শিল্পের কখনো পুরস্কার হয় না। শিল্পের ভার তো প্রকৃতি স্বীয় হাতে প্রদান করে।’
১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চলে যান অনন্তের পথে।
আহমদ ছফা একবার বলেছিলেন, ‘কোনো কোনো মানুষ জন্মায়, জন্মের সীমানা যাদের ধরে রাখতে পারে না।’ সুলতান তেমনি এক অদ্বিতীয় প্রজ্ঞার নাম, যিনি বাংলার মাটি ও মানুষের শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন চিরন্তন।
তিনি ছিলেন এক বিস্ময়, এক অনন্য সাধক। তার জীবন ছিল যেমন গভীর দর্শনের, তেমনি ছিল অভাবনীয় সরলতায় পূর্ণ। শতবর্ষে এস. এম. সুলতানকে স্মরণ করি বিনম্র শ্রদ্ধায়।
আপনার মতামত লিখুন :