বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


আবু ওবাইদা আরাফাত

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২৫, ০৮:৪৯ পিএম

অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান: যে আলো নেভেনি আজও

আবু ওবাইদা আরাফাত

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২৫, ০৮:৪৯ পিএম

আবু ওবাইদা আরাফাত। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

আবু ওবাইদা আরাফাত। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

লোকান্তরিত হয়ে গেলে অনেকেই হারিয়ে যান কালের গর্ভে। সময়ের বিচূর্ণ আয়নায় মানুষ ও সমাজের চিন্তার জগতে খুব শক্তভাবে নাড়া না দিলে ইতিহাসে স্থান করে নেওয়া কঠিন। ব্যস্ততম সময় ও যান্ত্রিক জীবনে মানুষ যখন হাঁফিয়ে ওঠে তখন মানুষ মূলের দিকে ধাবিত হওয়ার ফুরসত খোঁজে। আমাদের আত্মপরিচয়, নিজস্ব সংস্কৃতি ও মূলোবোধ চর্চার এই সংকটময় মুহূর্তে কিছু ব্যক্তিত্বের জীবনদর্শন ও জাতির প্রতি তাঁদের নিবেদিত কর্মকাণ্ড চোখের সামনে ভেসে ওঠে। 

লেখক, গবেষক ও কথাসাহিত্যিক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান তাদেরই একজন। তিনি ছিলেন সময়ের নির্মোহ ধারাভাষ্যকার। সাহসের পেখম মেলে দুহাত ভরে লিখে গেছেন বৈষম্যের কথা, বঞ্চনার কথা ও যাবতীয় অনাচারের কথা। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের শেকড়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে তাঁর লেখা কলামগুলো বিগত প্রজন্মের সাথে বর্তমান প্রজন্মের মধ্যকার যেন সাক্ষাৎ সেতু। 

এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব বীর চট্টলা তথা বাংলাদেশের সম্পদ। ৭৩ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি নিপীড়িত-শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের হয়ে কথা বলে গেছেন। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার নানাবিধ অসংগতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন রাজপথে, ডায়াচে, মাইক্রোফোনে, কলমে ও কলামে।  

তাঁর স্বকীয় ধারার সাহিত্যিক রচনায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ইতিহাস ও আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। ভাষা-আন্দোলন, ছাত্র-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, শ্রেণি সংগ্রাম, ভাসানীর রাজনৈতিক আদর্শ, বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল, বাঁকবদল ও তাঁর জীবন দর্শন সম্পর্কে রচনা করেছেন অনবদ্য সব গদ্যের সম্ভার।

তিনি ছিলেন তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, সুফিতত্ত্ব, বাউল, দেহতত্ত্ব ও লালন সাঁই’র দার্শনিক ভাবনার একনিষ্ঠ সাধক। বাংলাদেশের কৃষ্টি-কালচার, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে আপদপমস্তক সচেতন এই শিক্ষাবিদ তরুণ প্রজন্মের সাথে পূর্ব প্রজন্মের এক চমৎকার সেতুবন্ধনের প্রয়াস চালিয়ে গেছেন।

১৯৯১ সাল থেকে দৈনিক আজাদীতে মৃত্যুবধি লিখে চলা ‘বিরস রচনা’ শিরোনামের সরস কলামে তিনি পাঠক সমাজকে আন্দোলিত করে গেছেন। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ সাধুভাষায় লিখিত এসব কলামের প্রায় সব লাইন প্রবাদ বাক্যের মতো জীবন্ত, মর্মভেদী।

মানুষের চিন্তার জগৎকে প্রভাবিত করার মতো রচনাশৈলীর স্বভাবজাত গুণে দ্রুত সময়ে তাঁর একটি বিশাল পাঠকশ্রেণি গড়ে ওঠে। আজাদী ছাড়াও তিনি দৈনিক পূর্বদেশে ‘পথের প্যাঁচালী’ ও দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশে ‘সমসাময়িক’ শিরোনামে কলামের মধ্য দিয়ে তিনি দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সত্যাশ্রয়ী ভাষ্যকার হিসেবে আবির্ভূত হন। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে কাঙালের বাসিকথা, বিরস রচনা ও প্রতীতির পঙক্তিমালা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া আরও ৪ টি গ্রন্থে তিনি নিজস্ব ঢঙে রচনা লিখে পাঠকের মনোজগতে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছেন। 

অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান শিক্ষকতাকে কেবল চাকুরির গণ্ডিতে আবদ্ধ না রেখে জীবনব্যাপী শিক্ষাবিতরণে ব্রতী ছিলেন। এ লক্ষ্যে তাঁর পঠনপাঠন, সংগ্রহ ও গবেষণার গভীরতা ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বইয়ের বিশাল সংগ্রহশালা।

শ্রেণিকক্ষের শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়ার পরেও লেখালেখি ও বক্তৃতার মাধ্যমে গণমানুষের মাঝে নতুন নতুন জ্ঞান ও তথ্যভান্ডার উপহার দিতে তিনি শেষ বয়সে এসেও নিরলসভাবে গবেষণা ও পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন। 

তিনি একজন সুদক্ষ কথক বটে। হাঁটতে-বসতে, চলতে-ফিরতে কথা বলতেন চারপাশের মানুষের সাথে। তাঁর নিয়মিত পরিচ্ছদ খদ্দরে যেন ঢাকা পড়ে যেত মানবীয় অহংকার। পদ-পদবি ও জশ-খ্যাতির জৌলুসকে পাশ কাটিয়ে তিনি সাধারণভাবেই কাটিয়ে দিলেন এক অসাধারণ জীবন। অর্থকষ্টের অভাব না থাকলেও বিলাসিতা কখনো তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। অল্প দূরত্বে কখনো রিকশায় উঠতে দেখিনি তাঁকে। হেঁটেই চলে যেতেন গন্তব্যে। 

দেশবরেণ্য কলামিস্ট অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান ১৯৪০ সালের ১৪ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারার পরৈকোড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ইসমেইল খান ও মাতা ফাতেমা খানম। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে তিনি ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। চট্টগ্রামের প্রথম রাজবন্দি হিসেবে তিনি ১৯৬২ সালে মিছিল থেকে গ্রেপ্তার হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তিনি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কোষাধ্যক্ষ ও পরবর্তীতে ছাত্রশক্তির কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভের পর ঢাকার আবুজর গিফারী কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৭১ সালে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর তিনি নিজ জন্মস্থানে চলে আসেন।

বিভিন্ন প্রতিকূলতা ভেদ করে আনোয়ারা উপজেলার প্রথম কলেজ হিসেবে আনোয়ারা ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি এ কলেজের গুরু দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৮০ সালে তিনি ছাগলনাইয়া কলেজের অধ্যক্ষ ও ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম ওমরগণি এমইএস কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এ ছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ, হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, নোয়াখালী সরকারি কলেজ, কুমিল্লা নবাব ফয়েজুন্নেসা সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে গুরু দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ, সামাজিক সংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে অনন্য ভূমিকা রাখেন। 

তিনি কাজী সাইফুল হক সম্পাদিত সাহিত্য ম্যাগ দুর্দমের উপদেষ্টা ছিলেন। ২০১০ সাল আমাদের প্রতিষ্ঠিত নক্ষত্র সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর সম্পৃক্ততা আমাদের কাজে অসামান্য গতি সঞ্চার করে। অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান স্যারের কাছে তারুণ্যের কদর ছিল সর্বাগ্রে।

তাঁর জীবনের শেষ অর্ধযুগে খুব কাছে যাওয়ার সুবাদে এ কথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক, গবেষক ও সর্বোপরি জ্ঞানতাপস। রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে তাঁর বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে দেখার দুর্লভ সুযোগ অনেকের মতো আমাদেরও হয়েছে।

তাঁর সাথে কাটানো দীর্ঘ সময় এখন অসংখ্য স্মৃতি হয়ে বারবার হৃদয়ে নাড়া দেয়। স্মৃতিতে প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে স্যারের সাথে ঢাকা সফর, বাংলাদেশ বেতারের স্টুডিও, ঈদে মিলাদুন্নবির জুলুছ, বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও স্যারের বাসায় যাতায়াতের সময়গুলো।  তিনি আমাদের মাঝে আর নেই এই অমোঘ সত্যটা মেনে নিতে খুব বেগ পেতে হয়েছিল। আজ ১৪ নভেম্বর, এই মহান জ্ঞানতাপসের দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকী।

এখনো আমার মতো অসংখ্য ভক্ত, সুহৃদ ও শিক্ষার্থী খদ্দরের ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি পরিহিত কাঁধে থলে ঝুলানো খান স্যারকে খুঁজে বেড়ান জামালখানে, আন্দরকিল্লায়, চকবাজারে, কেবি আমান আলী রোডে কিংবা লেখক শিবিরের কোন আড্ডায়। কিন্ত তিনি চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে আছেন কাপাসগোলা জামতলা মসজিদের কবরস্থানে। তিনি ঘুমিয়ে থাকলেও তাঁর কর্ম-চেতনায় জাগিয়ে রেখেছেন তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহীকে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী হিসেবে কবুল করুক।

লেখক: প্রাবন্ধিক

Link copied!