ঢাকা মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর, ২০২৫

স্বর্ণের দাম কেন বারবার বাড়ছে

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: অক্টোবর ৭, ২০২৫, ০৩:০১ পিএম
স্বর্ণে চুড়ি। ছবি - সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ায় দেশের বাজারেও রেকর্ড গড়েছে মূল্যবান ধাতুটির দাম। সোমবার (৬ অক্টোবর) রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) জানিয়েছে, দেশের বাজারে প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৭২৬ টাকা। আজ মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) থেকে এ দাম কার্যকর হয়েছে।

এর মাধ্যমে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো স্বর্ণের দাম ভরিপ্রতি দুই লাখ টাকা ছাড়াল। এর আগে সর্বোচ্চ দর ছিল ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫৭৬ টাকা। অর্থাৎ এবার এক ধাপে ভরিপ্রতি দাম বেড়েছে ৩ হাজার ১৫০ টাকা।

ভরিপ্রতি নতুন দাম

বাজুসের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, নতুন দামে ২১ ক্যারেট স্বর্ণের ভরি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার ৬০৫ টাকা। ১৮ ক্যারেটের দাম হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ২২৯ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণের দাম প্রতি ভরি ১ লাখ ৩৬ হাজার ৪৪৫ টাকা।

বাজুস জানিয়েছে, স্থানীয় বাজারে তেজাবি স্বর্ণ বা পিওর গোল্ডের দাম বাড়ায় এই সমন্বয় করা হয়েছে। সমিতির স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিংয়ের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের চড়া দাম

বুলিয়নভল্ট ডটকম ও গোল্ডপ্রাইস ডটকম-এর তথ্য অনুযায়ী, সোমবার (৬ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেটে প্রতি আউন্স স্বর্ণ ৩ হাজার ৯৪৮ থেকে ৩ হাজার ৯৬৬ ডলার দরে কেনাবেচা হয়েছে। যা আগের দিনের তুলনায় প্রায় ১ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। এক মাস আগের তুলনায় এই বৃদ্ধি ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ।

রয়টার্স জানায়, সোমবার সেশনের শুরুতে স্বর্ণের দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৯৬৯ দশমিক ৯১ ডলারে পৌঁছায়। যদিও পরে তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৯৫৬ দশমিক ১৯ ডলারে। একই সময়ে ডিসেম্বর ডেলিভারির জন্য মার্কিন স্বর্ণের ফিউচার দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৯৭৬ দশমিক ৩০ ডলারে।

২০২৪ সালে স্বর্ণের দাম বেড়েছিল ২৭ শতাংশ। চলতি বছর এখন পর্যন্ত বেড়েছে প্রায় ৪৯ শতাংশ। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, স্বর্ণের এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা রেকর্ড ভাঙা গতি নিয়েই এগোচ্ছে।

মূল্যবৃদ্ধির কারণ কী?

বিশ্বজুড়ে আর্থিক অনিশ্চয়তা, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে স্বর্ণের দাম বাড়ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে শাটডাউনের পরিস্থিতি ও জাপানের ক্ষমতাসীন এলডিপির নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের জেরে ইয়েনের দরপতন হয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণকে বেছে নিচ্ছেন। এর ফলে বিশ্ববাজারে চাহিদা বেড়ে গিয়ে দামও বাড়ছে।

রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মূল্যবান ধাতব বিষয়ক বিশ্লেষক সুকি কুপার বলেন, ‘স্বর্ণের বাজার এখন এমন এক সময়ে প্রবেশ করছে, যখন মৌসুমি কারণে চাহিদা সাধারণত বাড়ে। এর সঙ্গে যদি ফেড সুদের হার কমায়, তবে স্বর্ণের দাম আরও নতুন উচ্চতায় যেতে পারে।’

কেসিএম ট্রেডের প্রধান বাজার বিশ্লেষক টিম ওয়াটার বলেন, ‘কম সুদের পরিবেশে স্বর্ণই সবচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ। তাই সারা বিশ্বের মানুষ স্বর্ণ মজুতে ঝুঁকছেন।’

বাংলাদেশে কেন এত দাম

বাংলাদেশি স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম যতদিন বাড়বে, দেশে দাম কমার সম্ভাবনা ততটাই কম।

এদিকে এক সাক্ষাৎকারে বাজুসের এক সদস্য বলেন, ‘স্বর্ণের দামের ওপর দেশের ব্যবসায়ীদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিশ্ববাজারে যেমন দাম বাড়ে বা কমে, এখানেও তার প্রতিফলন পড়ে।’

বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কারণে স্বর্ণের দাম বাড়ছে। যেমন- আমেরিকার শুল্কনীতি নিয়ে টানাপোড়েন, চীন-রাশিয়া-ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈঠক, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-সংক্রান্ত উত্তেজনা, ফ্রান্সের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জাপানের উৎপাদন নিয়ে উদ্বেগ। এসব কারণে ডলারের প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছে এবং স্বর্ণকে নিরাপদ বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে।’

তিনি আরও জানান, খনিতে উৎপাদন হ্রাস ও সরবরাহ কমে যাওয়াও দামের ঊর্ধ্বগতির অন্যতম কারণ।

বাড়তে পারে আরও

গত মাসে স্বর্ণের দামে কিছুটা স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত থাকলেও, মার্কিন সরকারের শাটডাউন পরিস্থিতি ফের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে। এখনই দামের নিম্নমুখী হওয়ার কোনো আভাস নেই।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক উত্তেজনা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকলে স্বর্ণের দাম আরও বাড়বে। ফলে সাধারণ ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বর্ণ এখন অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।