বাংলাদেশ গত এক দশকে ৬ শতাংশেরও বেশি স্থিতিশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তবে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরের পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি। টেক্সটাইল, আইটি, ফাইন্যান্স ও ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো উচ্চ প্রবৃদ্ধির খাতে দক্ষ স্থানীয় কর্মী না থাকায় বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমানভাবে বিদেশি শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে—বর্তমানে মধ্য ও উচ্চস্তরের পদে প্রায় পাঁচ লক্ষ বিদেশি পেশাজীবী কাজ করছেন।
ড. তানভীর আবীরের নেতৃত্বে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিপুলসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট বের হলেও শিল্পের চাহিদানুযায়ী প্রযুক্তিগত জ্ঞান, নেতৃত্ব ও সমস্যা সমাধান দক্ষতার ক্ষেত্রে গুরুতর ঘাটতি রয়েছে।
শনিবার (২৩ আগস্ট) রাজধানীর ধানমন্ডিতে ড্যাফোডিল প্লাজার দীপ্তি মিলনায়তনে আয়োজিত দক্ষতা বিভাজন দূরীকরণ: বাংলাদেশের মূল খাতগুলিতে বিদেশী শ্রম নির্ভরতা এবং কর্মী বাহিনী ঘাটতি মোকাবেলা শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্তাপন করেন গবেষক দলের প্রধান ড. তানভীর আবীর।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভাসিটির রেজিস্ট্রার ড. নাদির বিন আলী, এক্সটার্নাল এফেয়াসের পরিচালক প্রফেসর ড.সৈয়দ মিজানুর রহমান, ক্যারিয়ার ডেভেলাপমেন্ট সেন্টারের পরিচালক মোহাম্মদ মনজুরুল হক খান, প্রমুখ।
গবেষণার মূল বৈশিষ্ট্য
খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ: টেক্সটাইল, আইটি, ফাইন্যান্স ও ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে দক্ষতার অভাব স্পষ্টভাবে চিহ্নিত। বিদেশি বনাম স্থানীয় কর্মী তুলনা: নিয়োগকর্তারা প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও অভিযোজনক্ষমতার কারণে বিদেশিদের অগ্রাধিকার দেন।
প্রশিক্ষণের চাহিদা: হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ, শিল্প-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা ও কারিকুলাম আধুনিকীকরণকে জরুরি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গ্র্যাজুয়েট কর্মসংস্থানযোগ্যতা: স্থানীয় গ্র্যাজুয়েটদের প্রস্তুতি (৪-এর মধ্যে গড় স্কোর ২.৭২) শিল্পের প্রত্যাশার নিচে।
নীতি সুপারিশ: জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কাঠামো, লিঙ্গসমতা ও স্থানীয় মেধা ধরে রাখার প্রণোদনা।
অর্থনীতির ওপর প্রভাব
বিদেশি শ্রম নির্ভরতা কমানো: বছরে বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স বহিঃপ্রবাহ হ্রাস ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি: স্থানীয়দের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে উচ্চমূল্যের চাকরি সৃষ্টি।
বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় শক্তিশালী অবস্থান: শিল্পের চাহিদানুযায়ী শিক্ষা কাঠামো সাজানো গেলে রপ্তানি খাত ও বিনিয়োগে নতুন গতি আসবে।
সামাজিক সমতা: নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি শ্রমবাজারে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে।
সীমাবদ্ধতা ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
গবেষণাটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সীমাবদ্ধ হলেও ভবিষ্যতে বহুজাতিক তুলনামূলক বিশ্লেষণ অন্তর্ভুক্ত করে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা সায়েন্স, ব্লকচেইন, গ্রিন এনার্জি ও সাইবার সিকিউরিটির মতো ভবিষ্যতমুখী খাতে দক্ষতা চাহিদা চিহ্নিত করা জরুরি।
ফান্ডিংয়ের প্রয়োজনীয়তা
গবেষক দল মনে করে, স্থানীয় মেধা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ অবকাঠামোতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ছাড়া দক্ষতার ঘাটতি পূরণ সম্ভব নয়। এটি শুধু অর্থনীতিকে টেকসই করবে না, বরং বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও বহুগুণে বৃদ্ধি করবে।
সর্বোপরি, গবেষণাটি নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ ও শিল্পনেতাদের জন্য একটি কার্যকর রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করবে—যার মাধ্যমে বাংলাদেশ দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে আত্মনির্ভর অর্থনীতির পথে অগ্রসর হতে পারবে।