ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান কার্যালয় ও ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয় টানা ১৭ দিন ধরে তালাবদ্ধ। এতে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে সিটি করপোরেশনের নাগরিক সেবা কার্যক্রম। ঘনিয়ে আসছে কোরবানির ঈদ, কিন্তু হাট ব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য অপসারণে প্রস্তুতির সুযোগ পায়নি কর্তৃপক্ষ। নগরজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে চরম প্রশাসনিক স্থবিরতা।
বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে গত ১৪ মে থেকে নগর ভবনের মূল ফটকসহ ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয় তালাবদ্ধ করে রাখে দলটির নেতাকর্মীরা। পরদিন ১৫ মে থেকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায় নগর ভবন ও সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো।
এ অবস্থায় সীমিত পরিসরে কয়েকটি ওয়ার্ড কার্যালয়ের মাধ্যমে বর্জ্য অপসারণ, মশক নিধন ও বিদ্যুৎ বাতি চালু রাখার কাজ জোড়াতালির মতো করে চালিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। নগরের অনেক স্থানে আবর্জনা অপসারণ না হওয়ায় দুর্গন্ধে পরিবেশ দূষিত হয়ে উঠছে।
ডিএসসিসির এক নির্বাহী প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই আন্দোলনের কারণে সেবা ও উন্নয়ন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা চাই দ্রুত নগর ভবন খুলে দেওয়া হোক।
প্রতিদিন নগর ভবন ও আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে গড়ে ১০ হাজারেরও বেশি নাগরিক সেবা নিতে আসতেন। বর্তমানে জন্ম-মৃত্যু ও তালাক নিবন্ধন, হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়নসহ সব ধরনের সেবা বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া ঠিকাদাররা বিল তুলতে পারছেন না। ফলে জুন মাসের মধ্যে বিল প্রদান না হলে প্রকল্পের অর্থ ফেরত চলে যাবে সরকারি কোষাগারে।
রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাও এখন ঝুঁকিতে। মানুষ ট্যাক্স দিতে আসলেও অফিস বন্ধ থাকায় ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।
ডিএসসিসির আওতাধীন এলাকায় কোরবানির পশুর হাট ব্যবস্থাপনা, হাট ইজারা, অস্থায়ী বর্জ্য অপসারণ কেন্দ্র স্থাপন এবং ঈদের দিন থেকে নিরবচ্ছিন্ন বর্জ্য অপসারণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতির সময়ও ছিল এই সময়টুকু। কিন্তু নগর ভবন বন্ধ থাকায় প্রস্তুতি গড়ে ওঠেনি।
সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ঈদের সময় আবর্জনার পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এখনো প্রস্তুতি না নেওয়ায় পরিস্থিতি মারাত্মক হতে পারে।
নগর ভবনের অবস্থান কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেওয়া জাতীয়তাবাদী শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফুজ্জামান তুহিন বলেন, অফিস বন্ধ করে আন্দোলন করা আমাদেরও পছন্দ নয়। কিন্তু পরিস্থিতি বাধ্য করেছে। তবুও আমরা চাই দ্রুত তালা খুলে দেওয়া হোক।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক সচিব মশিউর রহমান। তিনি বলেন, এই অবরোধ আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে দিইনি, এটা নগরবাসীর স্পর্শকাতর প্রতিক্রিয়া। তবে আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনায় আছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আন্দোলন যেকোনো নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। তবে দিনের পর দিন অফিস বন্ধ করে রাখা অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য। বিকল্প পন্থা খুঁজে নেওয়া উচিত আন্দোলনকারীদের।
বুয়েটের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুসলেহ উদ্দীন হাসান বলেন, নগরসেবা যেন আন্দোলনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করা জরুরি।
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, নগর ভবন বন্ধ থাকা রাজনৈতিক ও আইনি বিষয়। আমরা বিষয়টি স্থানীয় সরকার বিভাগকে জানিয়েছি। এখনো কোনো নির্দেশনা পাইনি।
তিনি জানান, যারা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে ভোগান্তিতে রয়েছেন লাখো নাগরিক। সামনে ঈদুল আজহা- পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে নেমে আসতে পারে চরম অরাজকতা ও জনস্বাস্থ্য সংকট। সময় এসেছে দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে নগর ভবনের তালা খুলে দেওয়ার।
আপনার মতামত লিখুন :