ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫

‘এক মোবাইল নম্বরেই’ মা-মেয়ে হত্যার রহস্য উদঘাটন

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২৫, ০৭:৪৮ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে মা লায়লা আফরোজ (৪৮) এবং মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজকে (১৫) ছুরিকাঘাতে হত্যার প্রায় তিন দিনের মাথায় রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িত গৃহকর্মী আয়েশাকে বুধবার (১০ ডিসেম্বর) ভোরে তার স্বামী রাব্বির সঙ্গে ঝালকাঠির নলছিটি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত কমিশনার এন এস নজরুল ইসলাম এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত তুলে ধরেন।

নজরুল ইসলাম জানান, গত ৮ ডিসেম্বর সকালের দিকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। নিহত লায়লা আফরোজের স্বামী আজিজুল ইসলামের করা মামলায় নতুন গৃহকর্মী আয়েশাকে সন্দেহ করা হলেও তাকে শনাক্ত করা ছিল পুলিশের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। কারণ, কাজে যোগ দেওয়ার মাত্র তিন দিন আগে আসা এই গৃহকর্মীর কোনো ছবি, এনআইডি, মোবাইল নম্বর বা পরিচয় সংরক্ষিত ছিল না। সিসিটিভির ফুটেজেও তাকে স্পষ্ট চেনার উপায় ছিল না। কারণ, সে সবসময় বোরকা পরে মুখ ঢেকে চলাচল করত।

পুলিশ জানায়, কোনো ডিজিটাল ক্লু না পেয়ে তদন্ত দল তখন ‘ম্যানুয়াল’ উপায়ে থানায় গত এক বছরের গৃহকর্মীর মাধ্যমে সংঘটিত চুরির ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করতে শুরু করে। বিশেষ করে, গলায় পোড়া দাগ এবং জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় বসবাসকারী গৃহকর্মীদের তথ্য যাচাই করা হয়। এই সূত্রেই মোহাম্মদপুর থানার অধীন হুমায়ুন রোডে পূর্বে সংঘটিত একটি চুরির ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবার থেকে একটি পুরোনো মোবাইল নম্বর পাওয়া যায়, যা ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মূল সূত্র।

এই নম্বরটির কল ডেটা রেকর্ড বিশ্লেষণ করে জানা যায়, নম্বরটি ব্যবহার করতেন রাব্বি নামের এক ব্যক্তি। তদন্তে বেরিয়ে আসে, এই রাব্বির স্ত্রীই হলো পলাতক গৃহকর্মী আয়েশা। তাদের বর্ণনা বাদীর দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। পরে তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় বিভিন্ন স্থানে অভিযান শেষে অবশেষে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার চরকায়া গ্রামে তার দাদা-শ্বশুরবাড়ি থেকে আয়েশা ও তার স্বামী রাব্বিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় আয়েশার কাছ থেকে চুরি করা একটি ল্যাপটপও উদ্ধার করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আয়েশা হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। পুলিশকে জানান, কাজে যোগ দেওয়ার দ্বিতীয় দিনই তিনি দুই হাজার টাকা চুরি করেন। চতুর্থ দিন সকালে টাকা চুরির বিষয়টি নিয়ে গৃহকর্ত্রী লায়লা আফরোজের সঙ্গে তার তর্কাতর্কি হয়। লায়লা আফরোজ ফোনে তার স্বামীকে বিষয়টি জানাতে চেষ্টা করলে আয়েশা আগে থেকে লুকিয়ে আনা সুইচ গিয়ার চাকু দিয়ে পেছন থেকে তাকে আঘাত করেন। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে লায়লা আফরোজ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান।

এ সময়ে মায়ের চিৎকার শুনে ঘুম থেকে উঠে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজ মাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে আয়েশা তাকেও এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করেন। নাফিসা ইন্টারকমে গার্ডকে ফোন দিতে চাইলে আয়েশা ইন্টারকমের মূল তার ছিঁড়ে ফেলেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নাফিসারও মৃত্যু হয়।

এরপর নিজের রক্তমাখা কাপড় বদলে নাফিসার স্কুলড্রেস পরে বাসা থেকে বের হযন ঘাতক আয়েশা। ঢাকা ছাড়ার সময় সিংগাইর ব্রিজ থেকে মোবাইল ও পোশাকভর্তি ব্যাগ নদীতে ফেলে দেন।

অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম আরও জানান, আয়েশার আগেও চুরির অভ্যাস ছিল এবং তিনি তার নিজের বোনের বাড়ি থেকেও অর্থ ও স্বর্ণালংকার চুরি করেছিলেন।

এ সময় অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম ঢাকাবাসীর প্রতি ডিএমপি কমিশনারের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, ‘আপনারা যারা বাসায় গৃহকর্মী রাখেন তারা তাদের পরিচয় নিশ্চিত হবেন। আপনার বাসায় কাজ করা ব্যক্তির পরিচয়পত্র ও তাকে শনাক্তকারী ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করে রাখবেন। কারণ, এখানে আপনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয় জড়িত।’