পরিচয় দেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ‘কনসালট্যান্ট’। দুদকের জ্যাকেট পরা কয়েক ব্যক্তিকে নিয়ে দফায় দফায় অভিযানও পরিচালনা করেন। যদিও এর সঙ্গে দুদকের সংশ্লিষ্টতা নেই। দুদকের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে এভাবেই শেখ আবু মাহদী নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি এবং বিভিন্নজনকে হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ও মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করা হয়েছে।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের অনলাইন ভার্সনে শেখ আবু মাহদীর দুদকের ‘কনসালট্যান্ট’ পরিচয়ে চাঁদাবাজি ও প্রতারণা নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর মঙ্গলবার (২৪ জুন) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠান গণমাধ্যমে।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে যে, কিছু ব্যক্তিবিশেষ বিভিন্ন জায়গায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপদেষ্টা/ কনসালটেন্ট/ পরামর্শক/ সহযোগী/ সহকারী পরিচয় দিচ্ছেন। সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিয়োগকৃত কোনো উপদেষ্টা/ কনসালটেন্ট/ পরামর্শক/ সহযোগী/ সহকারী নেই। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ প্রদান করা হলো।’
মো. আকতারুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে জানান, দুদকের নাম ভাঙিয়ে কোনো ধরনের প্রতারণা করার সুযোগ নেই। এমন কেউ জড়িত থাকলে দুদক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার বা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।
অভিযোগের তথ্যমতে, সম্প্রতি আদালতে মামলা করেছেন শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি। মামলায় তিনি মাহদীর বিরুদ্ধে ২ কোটি টাকা চাঁদাবাজি, হয়রানি ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার অভিযোগ এনেছেন।
এজাহারে শাহরিয়ার আহমেদ উল্লেখ করেন, ‘গত বছরের ১৪ আগস্ট জনৈক গিয়াস উদ্দিন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরির জন্য তার কাছে তথ্য চান। গিয়াস বাদীকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মেট্রো লাউঞ্জ রেস্টুরেন্টে ডাকেন। সেখানে যাওয়ার পর গিয়াসের সঙ্গে অজ্ঞাত তিন ব্যক্তি আসেন, যারা নিজেদের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য পরিচয় দেন। ওই ব্যক্তিরা বাদীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে গুম করার হুমকি দেন। বাদীকে বাঁচতে হলে আবু মাহদীকে ২ কোটি টাকা দিতে হবে বলে জানান। অন্যথায় দুদকসহ বিভিন্ন স্থানে মামলা দেওয়া, নানাভাবে হয়রানি করা এবং গুম ও অপহরণ করাসহ বিভিন্ন হুমকি দেন। বাদী ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ‘২ কোটি টাকা দেবেন’ বলে প্রাণে বেঁচে ফেরেন। পরদিন আসামি গিয়াস ধানমন্ডির জেমকন টাওয়ারে অবস্থিত একটি কফি শপে যেতে বলেন। সেখানে আসামিদের পক্ষে ২০ লাখ টাকা নগদে নেন। বাকি টাকা আস্তে আস্তে দেবেন বলে জানান। ওই ঘটনার দুই দিন পর বাদী শাহরিয়ারের কাছ থেকে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার চেক দাবি করেন। ওই দিন সন্ধ্যায় নানান ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে জনতা ব্যাংক ফার্মগেট করপোরেট শাখার চারটি চেকের মাধ্যমে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লিখে নেন। গিয়াস, মাহদী ও আমান নামে তিন ব্যক্তি চেক নেওয়ার পর সেটা নগদায়ন করার জন্য নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন। বাদী পরবর্তী সময়ে আদালতে মামলা করেন।’
এ ছাড়া শাহরিয়ার চৌধুরীর কাছ থেকে জোরপূর্বক চেক নেওয়ার অভিযোগে মোহাম্মদপুর থানায় একটি জিডি করেছেন।
মাহদী ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে জুলস পাওয়ার লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিককে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং ৩ কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা জানান, জুলস পাওয়ার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় সৌরবিদ্যুৎ প্লান্টের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজ করে। গত ৩ মার্চ শেখ আবু মাহদী মোবাইল ফোনে তাদের টেকনাফ অফিসের ল্যান্ড কো-অর্ডিনেটর হেলালকে ফোন করে হুমকি দেন এবং হাত-পা ভেঙে পঙ্গু করে দেওয়ার কথা বলেন। এর আগে গত ২২ ডিসেম্বর একই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নাহিদুজ্জামানকে ফোন করে তার চাহিদা মাফিক টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে দুদকে মামলা দেওয়া, পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা এবং কোম্পানির চেয়ারম্যান মাহবুব আলমকে হত্যার হুমকি দেন। জুলস পাওয়ারের কর্মকর্তারা জানান, মাহদী তাদের কাছে ৩ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন।
মাহদী বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য চেয়ে হোয়াটসঅ্যাপ ও মোবাইল ফোনে খুদেবার্তা দিয়েছেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি ১৬ বছর ধরে বিদ্যুৎ খাতের অপরাধ ও দুর্নীতি নিয়ে কাজ করি। আমাকে আমার প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবেন। মাই কন্টাক্ট: মেজ. মাহদী (অব.)।’ এভাবে বিদ্যুৎ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে খুদেবার্তা পাঠিয়ে তথ্য চান মাহদী। পরে ওই সব ব্যক্তির কাছে চাঁদা চাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মেজর মাহদী পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুৎ ভবনে যান। তিনি নিজেকে দুদকের ‘কনসালট্যান্ট’ পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও অর্থ দাবি করেন। এ ছাড়া দুদকের জ্যাকেট পরা কয়েক ব্যক্তির সঙ্গে তিনি কয়েক দফায় অভিযানে আসেন। ওই ব্যক্তিরা প্রকৃত পক্ষেই দুদকের লোক কি না, সেটা নিশ্চিত হতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
দুদকের একজন পরিচালক জানান, দুদকে কনসালট্যান্ট নামে কোনো পদ নেই। দুদক এভাবে কাউকে নিয়োগ দেয় না। যদি কেউ দুদকে নিয়োগ পান, তাহলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে তার নিয়োগপত্র দিতে হবে; কিন্তু দুদক বা জনপ্রশানস মন্ত্রণালয় এ ধরনের পদে কাউকে নিয়োগ দেয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে শেখ আবু মাহদী বলেন, ‘আমি মাস দুয়েক ধরে দুদকের সঙ্গে কাজ করি। দুদকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি অভিযানে গিয়েছি। তাদের জন্য তথ্য সংগ্রহ করেছি।’
আপনি দুদকের কনসালট্যান্ট পরিচয় দেন কেন, আপনাকে কি দুদক কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুদককে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করেন। তারাই তাদেরটা বলুক। আমার কাছ থেকে জানতে চাইলে আপনি দুদকে আসেন। তাদের সামনে বসেই আপর প্রশ্নের জবাব দেব।’
শেখ আবু মাহদীর বিভিন্ন অপকর্মের প্রমাণ এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। এসব বিষয়ে দুদকের সংশ্লিষ্টদের কাছে জানতে চাইলে কর্মকর্তারা বলেছেন, তার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে বিভিন্ন অপরাধের তথ্য দুদকের কাছে এসেছে। তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তারা।