রাজধানীর পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে খুন করা হয় ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে। শত শত মানুষের উপস্থিতিতে একদল সন্ত্রাসী তাকে পিটিয়ে ও ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা করে।
এ ঘটনার তদন্তে উঠে এসেছে এক ভয়াবহ পরিকল্পনার চিত্র। তদন্তে জানা গেছে, খুনিরা পরিকল্পিতভাবে জনসমক্ষে এ ঘটনা ঘটায়, যেন হত্যাকাণ্ডকে মবকাণ্ড বা উত্তেজিত জনতার প্রতিক্রিয়ায় ঘটে যাওয়া একটি সাধারণ ঘটনা বলে বিবেচিত হয়।
সোহাগকে চাঁদাবাজ ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষ হিসেবে চিত্রিত করে হত্যার পেছনে একটি ‘জনরোষ’-এর গল্প দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু নৃশংস হত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় খুনিদের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায় এবং ঘটনাটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এই হত্যা মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা ও স্থানীয়রা জানান, সোহাগকে হত্যার আগেই তার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালানো হয়। তাকে আওয়ামী লীগপন্থি ও ব্যবসায়ী সমাজের শত্রু হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টাও চালান খুনিরা।
হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনায় ছিলেন চকবাজার থানা যুবদলের সদস্য সচিব পদপ্রার্থী মাহমুদুল হাসান মহিন এবং একই থানার ছাত্রদলের সদস্য অপু দাস। তাদের লক্ষ্য ছিল এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদাবাজি সহজ করে তোলা।
তদন্তে আরও জানা গেছে, সোহাগের ‘সোহানা মেটাল’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে একটি সরু গলির মধ্যে, যেখানে লোকজনের চলাচল কম। কিন্তু খুনিরা চেয়েছিল হত্যাকাণ্ডটি প্রকাশ্যে ঘটিয়ে ‘জনতার হাতে শাস্তি’-র রূপ দিতে, যাতে এটি রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে হালকাভাবে বিবেচিত হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, একসময় সোহাগ ও খুনিচক্র একসঙ্গে চলাফেরা করতেন। একে অপরের বাসায় দাওয়াতেও যেতেন। কিন্তু ২০২৩ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে ব্যবসা দখল ও চাঁদা দাবিকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এরই চূড়ান্ত রূপ নেয় এই হত্যাকাণ্ডে।
নিরাপত্তা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে সমালোচনা
সোহাগ হত্যার সময় আনসার ও পুলিশের উপস্থিতি না থাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে তীব্র প্রশ্ন উঠেছে। হাসপাতালের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যদের কেউ ঘটনাস্থলে এগিয়ে আসেননি। এমনকি সেখানে কোনো পুলিশ সদস্যকেও দেখা যায়নি। স্থানীয় বাসিন্দা ও রোগীরা বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আনসার ক্যাম্পের সামনে শাড়ি ও চুড়ি উপহার দেন, যা প্রতীকীভাবে বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ও লজ্জাজনক আচরণের প্রতিবাদ। একজন শিক্ষার্থী বলেন, “জনগণের টাকায় যারা বেতন পান, তারা যদি জনগণকে রক্ষা না করেন, তাহলে তাদের দরকার নেই।”
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম জানান, কেউ পুলিশ হেল্পলাইন ‘৯৯৯’-এ ফোন করেনি এবং কেউ আনসার সদস্যদেরও কিছু জানায়নি। ফলে তারা সরাসরি কিছু করতে পারেননি।
আনসার মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ দাবি করেন, সদস্যরা নির্ধারিত রোস্টার অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করেছেন এবং রোস্টারের বাইরে গিয়ে স্বপ্রণোদিতভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ ছিল না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকেও এক বিবৃতিতে জানানো হয়, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মূল অভিযুক্ত মাহমুদুল হাসান মহিনকে আটক করে এবং পরে তার তথ্যে আরও একজন আসামি তারেক রহমান রবিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর প্রচার চালানো হচ্ছে বলেও জানায় ডিএমপি।
রিমান্ড ও বিচার বিভাগীয় তদন্তের আবেদন
সোহাগ হত্যা মামলায় আরও দুই আসামি, আলমগীর ও মনিরকে চার দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। আদালতে উপস্থাপন করা আবেদনের ভিত্তিতে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. সেফাতুল্লাহ এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এ ছাড়া, ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত ও প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছেন আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। সোমবার (১৪ জুলাই) বিচারপতি কাজী জিনাত হক ও বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকার বেঞ্চে রিটটি শুনানির জন্য ওঠার কথা রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের ‘শাটডাউন’ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি
নিরাপত্তাহীনতার প্রতিবাদে মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা আন্দোলনে নেমেছেন। শিক্ষার্থীরা হাসপাতাল ‘শাটডাউন’ ঘোষণা করেন এবং ইন্টার্ন চিকিৎসকরা এক দিনের কর্মবিরতি পালন করেন। তারা জানান, নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে।
সোহাগের পরিবারের পাশে বিএনপি
সোহাগ হত্যার পর তার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে বিএনপি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম মণি সোহাগের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান ও সমবেদনা জানান।