রবিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


সামজীদ হোসেন

প্রকাশিত: জুলাই ২৭, ২০২৫, ০১:৩৫ এএম

ক্যাসিনোয় বন্দি ইউরোপের স্বপ্ন

সামজীদ হোসেন

প্রকাশিত: জুলাই ২৭, ২০২৫, ০১:৩৫ এএম

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

সন্তান ইউরোপ যাবে। ভালো চাকরি করে পরিবারের দারিদ্র্য ঘোচাবে। এই স্বপ্নে যশোরের শাওনের মা জমি বিক্রি করে সাত লাখ টাকা তুলে দেন দালালের হাতে। কথা ছিল, শাওন প্রথমে যাবে মালয়েশিয়া সেখান থেকে আকাশযোগে পৌঁছাবে ইতালি কিংবা অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু সেই টিকিটে শাওনের গন্তব্য হয় কম্বোডিয়ার এক ক্যাসিনোর বন্দিশালায়। ক্যাসিনো হেলে আটকে রেখে চলে অমানবিক নির্যাতন, পরিবারকে হুমকি দিয়ে আদায় করা হয় আরও ৪ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। বন্দি জীবন থেকে মুক্তি মেলে বটে, তবে শাওনের জীবন থেমে গেছে স্বপ্নভঙ্গের অন্ধকার গহ্বরে। 

এমন গল্প শুধু শাওনেরই নয়। নরসিংদী, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও- এ জেলাগুলোর বিভিন্ন এলাকা এখন মানব পাচারের হটস্পট। ইউরোপের স্বপ্ন দেখিয়ে বাংলাদেশি তরুণদের কম্বোডিয়ায় পাচার করছে একাধিক শক্তিশালী আন্তর্জাতিক চক্র; যার একটির নেতৃত্বে রয়েছেন বাংলাদেশি মাসুম রেজা মাসুদ। তবে মাসুম শুধু একা নন, তার সহযোগীরা এই প্রতারণার অর্থনৈতিক কাঠামো চালাচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। যার প্রমাণ মিলেছে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে।

মাসুম রেজা মাসুদের ‘নমপেন সিন্ডিকেট’
রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। একসময় বাবার সঙ্গে হাঁটে ফেরি করে কাপড় বিক্রি করতেন মাসুম রেজা মাসুদ। তারই এখন সম্পদের পাহাড়। স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে থাকেন কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে। গড়ে তুলেছেন একাধিক বাড়ি। তার সংগ্রহে রয়েছে রেঞ্জ রোভার, মার্সিডিজ বেঞ্জের একাধিক গাড়ি। নিজেকে ‘আইটি কোম্পানির এমডি’ পরিচয় দিয়ে চালাচ্ছেন ক্যাসিনোভিত্তিক অবৈধ প্রতারণা চক্র।

মাসুম রেজার সিন্ডিকেটে রয়েছেন আরেক বাংলাদেশি আব্দুল হালিম। ৬০ বছর বয়সি হালিম এক সময় বাংলাদেশে ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা করতেন। বর্তমানে কম্বোডিয়ার নমপেনে মাসুম রেজার প্রতিবেশী তিনি। দুজনের নেতৃত্বে চলে এই সিন্ডিকেট। পাশাপাশি বাংলাদেশে তাদের রয়েছে একাধিক দালাল চক্র। ইউরোপে লোক পাঠানোর জাল ডকুমেন্ট তৈরি করে বাংলাদেশি তরুণদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলছেন তারা।

রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতারণার কৌশল হিসেবে প্রথমে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে ‘ওয়ার্ক পারমিট’, ‘কম খরচে ইউরোপ ভিসা’ অথবা ‘মালয়েশিয়া ট্রানজিটে ইউরোপ’- এমন লোভনীয় প্রতিশ্রুতি দিয়ে টার্গেট করা হয় বাংলাদেশি তরুণদের। ভুয়া কাগজপত্রে তাদের পাঠানো হয় মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কিংবা লাওসে। সেখান থেকে পাচারের মাধ্যমে পাঠানো হয় কম্বোডিয়ায়। ভিসা হাতে পেতে দেরি হবে এমন অজুহাতে চাকরি দেওয়া হয় ক্যাসিনোতে। কিন্তু আদতে তাদের বিক্রি করা হয় ক্যাসিনোয়। সেখানে নিয়ে তাদের ওপর চলে নির্যাতন, করা হয় মুক্তিপণ দাবি। নতুবা শুধু থাকা-খাওয়ার বিপরীতে ক্যাসিনোতে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। কেউ ফিরে এলে তার মুখে একটাই কথা ‘আমাদের বিক্রি করে দিয়েছে।’

যেভাবে বিক্রি করা হয়

রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে জানা যায়, ইউরোপের স্বপ্ন দেখিয়ে বডি কন্ট্রাক্টে প্রথমে নেওয়া হয় মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ড। সেখান থেকে বিমান পথে কম্বোডিয়া। তারপরে বিক্রি করা হয় বিভিন্ন ক্যাসিনো হেল বা জুয়া ঘরে। এজন্য প্রত্যেক কর্মী বাবদ সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার ডলার পান মাসুম।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুষ্টিয়ার এক ভুক্তভোগী বলেন, আমাকে মালয়েশিয়ায় নেওয়া হয়েছিল, সেখান থেকে কম্বোডিয়ায়। এরপর কাজ দেওয়ার অজুহাতে তুলে দেওয়া হয় এক অজানা ব্যক্তির হাতে। ওই ব্যক্তি পাসপোর্ট ও মোবাইল কেড়ে নেয়। এখন তারা বলছে, ক্যাসিনো থেকে বের হতে হলে দিতে হবে ৫ হাজার মার্কিন ডলার। মৃত্যুর শংকা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আপনার সঙ্গে কথা হয়েছে জানতে পারলে ওরা আমাকে হত্যা করবে।
ওই ভুক্তভোগী আরও বলেন, মাসুম রেজার হাতে ধরে যারা ইউরোপে যাত্রার আশায় কম্বোডিয়ায় এসেছে তাদের প্রত্যেককেই ক্যাসিনোতে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে যারা মুক্তিপণ দিয়েছে, শুধু তারাই বের হতে পেরেছে। নতুবা এখান থেকে পালিয়ে থাইল্যান্ড যেতে হয়। এখান থেকে বাঁচার কোন উপায় নাই। 

মাসুম রেজা সিন্ডিকেটের হাত থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে ফিরেন নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের মিজানুর রহমান ও তার ফুপাতো ভাই কামাল হোসেন পিন্টু। রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানী টিমের সঙ্গে কথা হয় এই দুই ভুক্তভোগীর। 

অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে দুই ভাইয়ের কাছ থেকে প্রায় ৪৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মাসুম রেজা। মিজানুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে জানান, কাজের সন্ধানে তিনি যখন কম্বোডিয়ায় ছিলেন, তখন মাসুম রেজার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মাসুম তাকে উন্নত জীবনের আশ্বাস দিয়ে বলেন, ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে তিনি মিজানকে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠাতে পারবেন। প্রথমে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার পর মাসুম তার কাছ থেকে ধাপে ধাপে ১৮ লাখ টাকা নেন। পরে মিজানুর তার ফুপাতো ভাই কামাল হোসেন পিন্টুকে মাসুমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কামালকেও একইভাবে অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে মোট ২৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। ভিসা ও টিকিটের কথা বলে তাদের দুজনকে পাঠানো হয় ভিয়েতনাম। কিন্তু ভিয়েতনাম যাওয়ার পর চতুর মাসুম তাদের সঙ্গে  যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।

তারা আরও জানান, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, দুই ভাই ভিয়েতনাম থেকে দালালের সহায়তায় পুনরায় কম্বোডিয়ায় ফিরে যান এবং সেখান থেকে আবার থাইল্যান্ড হয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। দেশে ফেরার সময় দালালকে আলাদাভাবে আরো ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা করে দিতে হয় তাদের।

কামাল হোসেন পিন্টু বলেন, আমার তিন মেয়ে, বাবা-মা, পরিবার নিয়ে এখন আমি নিঃস্ব। মাসুম রেজার প্রতারণায় পড়ে আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। এখন দেনার দায়ে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়।

দেশে ফিরতে চাইলে গুলি করে হত্যার হুমকি কম্বোডিয়ায় পৌঁছানোর কয়েকদিন পরেই বুদ্ধিমান তরুণদের কেউ কেউ মাসুমের চতুরতা বুঝতে পারে। তখন যেকোনো উপায়ে দেশে ফিরতে চায় তাদের কেউ কেউ। কিন্তু মুক্তিপণের টাকা না দিয়ে দেশে ফিরতে পারে না কেউ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বর্তমানে কম্বোডিয়ায় অবস্থানরত এক ভুক্তভোগী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমাকে আটকে রেখে মাসুম রেজা তার ব্যক্তিগত কাজ করতে বাধ্য করত। কিন্তু বেতন দিত না। আমি তার কাছে টাকা চাইলেই মারধর করত। পাশাপাশি পাহাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যার হুমকিও দিত।

তিনি বলেন, উচ্চ বেতনে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ায় চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সে অনেককেই কম্বোডিয়ায় এনেছে। কিন্তু কাউকেই ইউরোপে পাঠায়নি। ইউরোপে না পাঠিয়ে তাদের ক্যাসিনো হেলে বিক্রি করে দেয়। এটা তার আয়ের আরেকটি খাত।

একই গল্প, একাধিক শিকার

উন্নত জীবনের স্বপ্নে বিভোর আরও অনেকেই একই কৌশলে পাচার হয়েছেন কম্বোডিয়ায়। অনুসন্ধানের একপর্যায়ে কথা হয় কুষ্টিয়ার সোহাগ ও রকি নামের দুই যুবকের সঙ্গে। পরিবারের সহায় সম্বল বিক্রি করে ৫ লাখ ও ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন দালালের হাতে। আজ তারা নিঃস্ব, প্রবাসে নিগৃহীত। শুধু তারাই ননÑ ভুক্তভোগীদের তালিকায় আরও রয়েছেন আলীউর রহমান, শারিফুল ইসলাম, সোহাগ মিয়া, রাসেদ মিয়া, সৈয়দ মোস্তফা মীর, তানজিদ আহমেদ, একরামুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, জালাল মিয়া,  কুদ্দুস মিয়া, মামুন মিয়া ও মনির হোসেন। তারা সবাই এক প্রতারক চক্রের হাতে প্রতারিত হয়েছেন। যারা ইউরোপের স্বপ্ন দেখিয়ে, ‘ট্রাভেল ভিসা’, ‘ওয়ার্ক ভিসা’, এমনকি ভুয়া ইমপ্লয়মেন্ট লেটার দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

মানব পাচারের অভিযোগের বিষয়ে মাসুম রেজা মাসুদের কম্বোডিয়ার মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি তাকে ম্যাসেজ করা হলেও তিনি এর কোনো প্রত্যুত্তর দেননি।  

ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ম্যানেজার আল-আমিন নয়ন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রবেশপথে কড়া পর্যবেক্ষণ, ট্রাভেল ভিসা যাচাই এবং বিদেশে লিগ্যাল সাপোর্ট সেল গঠন করা না গেলে এই পাচার বন্ধ হবে না। তিনি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ভুক্তভোগীদের জন্য পুনর্বাসন ঋণ চালু, কাউন্সেলিং সেবা এবং ই-ভিসা যাচাইয়ের জন্য একক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালুর পরামর্শ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে সিআইডির এসএসপি সিরিয়াস ক্রাইম মো. বদরুল বলেন, ‎আমরা মানব পাচার বন্ধে কাজ করছি। আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য বা অভিযোগ থাকলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে এটা নিয়ে কাজ করি। সম্প্রতি ইউরোপের কথা বলে কম্বোডিয়ায় নিয়ে গিয়ে প্রতারিত এক ভুক্তভোগীর অভিযোগ পেয়েছি। তার অভিযোগ নিয়ে ইতোমধ্যে আমাদের তদন্ত চলমান। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অথবা ভিকটিম যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করেন, সেটা আমরা খতিয়ে দেখি। ‎পৃথিবীর যেকোনো দেশে কেউ যদি বন্দি থাকে অথবা দুষ্ট চক্রের কবলে  পড়ে আমরা সবসময় এ বিষয়ে কাজ করতে প্রস্তুত এবং করেও যাচ্ছি।

Shera Lather
Link copied!