শুক্রবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মাইনুল হক ভূঁইয়া

প্রকাশিত: মে ২৪, ২০২৪, ০২:৪১ এএম

দেনায়, লোকসানে লুটপাটে কাবু

ডুবতে বসেছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক

মাইনুল হক ভূঁইয়া

প্রকাশিত: মে ২৪, ২০২৪, ০২:৪১ এএম

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেনায়, লোকসানে, লুটপাটে কাবু দেশের আর্থিক খাতের অন্যতম শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এখন প্রায় ডুবতেই বসেছে। অবস্থা এমন সংকটাপন্ন যে, কিছুদিন কিস্তিতে আমানকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারলেও এখন তাও পারছে না ব্যাংকটি। আমানতকারীদের চাপ সামলাতে না পেরে বিভিন্ন শাখার ম্যানেজার পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক তাদের ৩৩ শাখায় মাত্র ৩৫০ কর্মীর বেতনও ঠিক-ঠাক দিতে পারছে না। মাঝখানে কর্মীদের মাস মাইনে ধাপে ধাপে কিছু কিছু করে দিলেও এখন তাও দিতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকটি।

বর্তমানে ব্যাংকটির তারল্য সংকট এতোখানি তীব্র আকার ধারণ করেছে যে, ১০ হাজার টাকার জন্য এক গ্রাহক একমাস ধরে ঘুরেও তুলতে পারছেন না। বারবারই তাকে জানানো হচ্ছে, ‘টাকা নেই, পরে আসেন। ’২০০৮ সালে সীমাহীন লুটপাটে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক’-এর ধ্বংসস্তুপ থেকে জন্ম নেওয়া আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক বছরের শুরু থেকে তারল্য সংকটের তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। এখন এটির দম বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কয়েক বছর ধরে ব্যাংকটি লোকসানে জর্জরিত। ২০২৩ সালে এর লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৫৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। শুধুমাত্র লোকসানের কারণেই দীর্ঘদিন ধরে আইসিবি ইসলামি ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করতেও ব্যর্থ হয়েছে।

জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাংকটির প্রায় ৪২৫ কোটি টাকার দেনা রয়েছে। সে কারণে তারল্য সংকট উত্তরণে গত ৩১ জানুয়ারী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ৫০ কোটি টাকা জামানতমুক্ত সহায়তা চেয়েও পায়নি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। শুরু থেকে অনাদায়ী মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকটিকে দুষছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তথ্য বলছে, ব্যাংকটির বিতরণকৃত ৭৯০ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা ঋণের ৮৭ ভাগই খেলাপী, অর্থাৎ অনাদায়ী।

বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের শেষ দিকে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের আমানত ছিল ১ হাজার ২১২ কোটি টাকা, তন্মধ্যে ৪শ’ ৪৪ কোটি টাকা ছিল ‘ফ্রোজেন ডিপোজিট’। এই ফ্রোজেন ডিপোজিট হলো ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের আমানত, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হেফাজতে ছিল। ২ হাজার কোটি টাকার মতো ছিল ব্যাংকটির ফ্রোজেন ডিপোজিট। প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী, ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের আমানতকারীদের ২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

এই ব্যাংকটির গোড়াপত্তন ১৯৮৭ সালে। তখন এটি ‘আল বারাকা ব্যাংক’ নামে পরিচালিত হতো। ১৯৯৪ সালে এটি সমস্যাজর্জর ব্যাংক হিসেবে চ‎িহ্নত হয়। ফলে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা আনতে ত্রুটি-বিচ্যুতি পরায়ন ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ২০০৪ সালে এটি ওরিয়েন্টাল ব্যাংক নামে কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু দুই বছরের মাথায় ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়লে ২০০৬ সালের জুন মাসের দিকে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই সঙ্গে আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষার স্বার্থে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই একজন নির্বাহী পরিচালককে।

২০০৭ সালের আগস্ট মাসে ব্যাংকটির সিংহভাগ শেয়ার বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন এশিয়া ও আফ্রিকায় ব্যাংকিং ব্যবসা পারিচালনাকারী সুইস আইসিবি গ্রুপের সঙ্গে দু’জন দরদাতা দরপত্রে অংশ নেন। ২০০৮ সালে ব্যাংকটি খোলস পাল্টে ‘আইসবি ইসলামিক ব্যাংক’ নাম ধারণ করে ব্যাংকিং জগতে বিচরণ শুরু করে। যাত্রালগ্ন থেকেই নানা অনিয়ম, অব্যবস্থা, পরিচালকদের নামে-বেনামে ঋণ নেওয়া এবং ঋণ ফেরতে অনীহা ধীরে ধীরে ব্যাংকটিকে ‘অসুস্থ’ করে তোলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারংবার সতর্ক করেও ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে খেলাপী ঋণের পরিমাণ এতো বাড়-বাড়ন্ত হয় যে, তা ‘অসহনীয় মাত্রা’য় গিয়ে পৌঁছে। ফলশ্রুতিতে যা হবার তা-ই হয়। আমানত কমতে কমতে ব্যাংকটি এক সময় গতি হারিয়ে ফেলতে বসে। পাল্লা দিয়ে হ্রাস পায় তারল্য।


পর্যায়ক্রমে সেই সংকট তীব্র হয়ে আজকের ভয়াবহতায় রূপ নেয়। মাঝখানে জানুয়ারীর শেষভাগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জামানতমুক্ত ৫০ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা চেয়েছিল ব্যাংকটি। কিন্তু আবেদনের দু’সপ্তাহের মাথায় তা প্রত্যাখ্যাত হয়। কারণ, ইতোমধ্যেই ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ৪২৫ কোটি টাকা দেনায় ছিল।

ব্যাংকটির আদ্যোপান্ত ওয়াকিবহাল আছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন ক’জন কর্মকর্তা জানান, আইসিবি’র অবস্থা এতাটাই ভয়াবহ যে ব্যাংকটির কাছে এমন কোনো আমানত নেই, যার বিপরীতে এটি অন্য কোনো ইসলামি ব্যাংক কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নগদ অর্থ ধার করতে পারে (ব্যাংকিং পরিভাষায় যাকে বলা হয়, Borrow)।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো: মেজবাউল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা ব্যাংকটির বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত আছি।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের একটি বিরাট অঙ্কের তহবিল কিছু লিজিং কোম্পানীর কাছে আটকে আছে। বর্তমান তারল্য সংকটের এটিই প্রধানতম কারণ।’ কথা প্রসঙ্গে তিনি আশার কথাও শোনালেন।

বললেন, ‘আমরা ব্যাংকটির মালয়েশিয়ান শেয়ার হোল্ডারদের নতুন করে তহবিল যোগান দিতে বলেছি।’ মেজবাউল আশ্বস্ত করলেন, ‘আমানতকারীরা যেনো টাকা ফেরত পান, আমরা তা নিশ্চিত করবো।’

এদিকে, আইসিবি’র বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলো একীভূতকরণের সংবাদে বিচলিত হয়ে অর্থ তুলে নিতে একই সময়ে আমানতকারীদের চাপ ব্যাংকটির পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। একই কারণে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমানত সংগ্রহ হ্রাস পাওয়া। সংকটাপন্ন ব্যাংকটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার এখন একমাত্র পথ হলো, দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটিকে নতুন মূলধন যোগান দেওয়া।

ওদিকে মেয়ের বিয়ের জন্য আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখায় জমানো ১১ লাখ টাকা তুলতে পারছেন না আশিষ কুমার পাল। চেক নিয়ে বারবার ব্যাংকে গেলেও নগদ টাকা নেই বলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখা থেকে টাকা উঠাতে না পেরে অবশেষে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে আসেন আশিষ কুমার পাল। এখানে এসেও তিনি টাকা উঠানোর কোনো ব্যবস্থা করতে পারেননি।

আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে কিছুক্ষণ: মতিঝিল শাখায় গ্রাহক সেজে এই প্রতিবেদক টাকা তুলতে গেলে একজন নারী কর্মকর্তা জানান, তাদের ক্যাশে সমস্যা আছে। এখন টাকা তোলা যাবে না। শাখার ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি জানান, ম্যানেজার বাইরে গেছেন। কখন আসবেন জানি না।

তবে এ শাখার সিকিউরিটি গার্ড জানায়, ম্যানেজার অফিস করেন না। গ্রাহকরা টাকা তোলার জন্য আসেন। তিনি টাকা দিতে না পেরে অফিসে আসা বিরত রেখেছেন। একই শাখায় সকাল থেকে ব্যাংকে ম্যানেজারের জন্য অপেক্ষারত গ্রাহক শাহিনুর এবং কাদের মোল্লা। তারা দুজনই বেশ কয়েকদিন ধরে ব্যাংকে আসছেন তাদের টাকা তুলতে। কিন্তু ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না। তাই তারা ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। ব্যাংকটির গ্রাহক শাহিনুর বলেন, ‘আমি ১ হাজার টাকা ওঠাবো ব্যাংক থেকে কিন্তু এটা পারছি না। ব্যাংক আমাকে টাকা দিতে পারছে না। ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন ব্যাংকে নাকি টাকা নাই। আমরা ম্যানেজারের জন্য অপেক্ষা করছি কিন্তু সকাল থেকে তার কোনো খোঁজ নেই।’

কতোদিন ধরে ১ হাজার টাকা তোলার জন্য আসছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে এ গ্রাহক বলেন, ‘আমি ১৫ দিন ধরে আসছি, কিন্তু তারা কোনো টাকা দিতে পারছে না। আমার সহকর্মী কাদের মোল্লা ভাই ১০ হাজার টাকার জন্য প্রায় এক মাস সময় ধরে ব্যাংকে আসছেন কিন্তু তিনি টাকা পাচ্ছেন না। ব্যাংকে নাকি টাকা নেই।’ শুধু মতিঝিল প্রিন্সিপাল শাখা-ই নয়, ব্যাংকটির নয়াপল্টন ভিআইপি শাখায় একই চিত্র দেখা যায়। এই শাখায়ও বেশ কিছুদিন ধরে টাকা উত্তোলনের জন্য ম্যানেজারের পেছনে ঘুরছেন কয়েকজন গ্রাহক।

এ শাখায় আসা জাকির হোসেন নামে একজন গ্রাহক গতকাল জানান, ব্যাংকের ভল্টে টাকা নেই, তাই ম্যানেজার কেবল আশ্বাসই দিচ্ছেন। গত ঈদের আগে এই ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা আসে। ব্যাংক থেকে আজ-কাল বলে শুধু ঘুরাচ্ছে। কিন্তু টাকা দিতে পারছে না। এমনকি ৫ হাজার টাকা চাইলাম সেটাও দিতে পারল না।

আক্ষেপ করে আরেক গ্রাহক গোলাম মোস্তফা বলেন, ১০ বছর ধরে আমার অ্যাকাউন্ট এই ব্যাংকে। কুমিল্লা থেকে ৪ লাখ টাকা পাঠিয়েছে এক ক্লায়েন্ট। তাকে বললাম, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে টাকা না পাঠাতে। কিন্তু সে টাকা পাঠিয়ে আমাকে বিপদের মধ্যে ফেলেছে।

তিনি বলেন, ৫০ হাজার টাকা তুলতে এসেছি। কিন্তু টাকা দিতে পারছে না। শুধু জাকির বা মোস্তফা নন, গত সপ্তাহে ব্যাংকটির মৌলভীবাজার শাখার গ্রাহক আব্দুল হামিদ মাহবুব টাকা তুলতে গেলে তাকে কোনো টাকা দেয়া হয়নি। ওই শাখায় তার এক লাখ টাকা জমা রয়েছে। গত মঙ্গলবার সকালের দিকে ওই ব্যাংকের নিজ অ্যাকাউন্ট থেকে ৫৫ হাজার টাকা উত্তোলনের জন্য চেক নিয়ে গেলে তাকে টাকা না দিয়েই ফিরিয়ে দেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।

কারণ হিসেবে জানান, ব্যাংকে পর্যাপ্ত টাকা নেই। তিনি ওই চেকের ছবি দিয়ে তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসও দেন।

এ বিষয়ে জানতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতি অনাকাঙ্খিত এবং তা অবশ্যই সাময়িক। আমরা সংকট উত্তরণের চেষ্টা করছি’। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আগামী জুনের মাঝামাঝি আমরা এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবো’।

Link copied!