ঢাকা শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ডাকসু নির্বাচনে কার লাভ, কার ক্ষতি?

ডয়চে ভেলে
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৫, ০৬:৫৫ পিএম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভবন। ছবি- সংগৃহীত

আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন। আসন্ন ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে এরই মধ্যে ক্যাম্পাসে প্রচারণা শুরু করেছেন বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা। গণঅভ্যুত্থানের পর এই প্রথম বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হচ্ছে।

আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। তার আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই নির্বাচন আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে। এমন পরিস্থিতে অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন ডাকসু নির্বাচনে কার লাভ বা কার ক্ষতি?  

এবার ডাকসু নির্বাচনে সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রার্থী লড়ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন, যেখানে ২৮টি পদে মোট ৪৭১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এর মধ্যে রয়েছে ৬২ জন ছাত্রী। এবারের নির্বাচনে মোট ৫টি প্যানেলে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে।

ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) পদে ৪৫ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ১৯ জন এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ২৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন, কমনরুম, আন্তর্জাতিক, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, গবেষণা-প্রকাশনা, ক্রীড়া, ছাত্র পরিবহন, সমাজসেবা, স্বাস্থ্য-পরিবেশ, মানবাধিকার-আইনবিষয়ক ও ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টসহ অন্যান্য সম্পাদক পদেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থী রয়েছেন।

৪৭১ জন প্রার্থীর মধ্যে ৬২ জন ছাত্রী রয়েছেন। তাদের মধ্যে ভিপি পদে ৫ জন, জিএস পদে ১ জন ও এজিএস পদে ৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। বিভিন্ন সম্পাদক পদেও ছাত্রী প্রার্থীদের ভালো অংশগ্রহণ দেখা গেছে, যেমন কমনরুম-রিডিংরুম-ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ৯ জন, গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে ৩ জন এবং সদস্য পদে ২৫ জন ছাত্রী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

চূড়ান্ত ফলাফলের আগেই ২৮ জন প্রার্থী তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। এ ছাড়া প্রাথমিক বাছাইতে বাদ পড়া ১০ জন প্রার্থী আপিল না করায় তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। এর ফলে চূড়ান্তভাবে ৪৭১ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন।

চূড়ান্ত তালিকা অনুযায়ী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে ৫৯ জন, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ৩১ জন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ৬২ জন, জগন্নাথ হলে ৫৫ জন, ফজলুল হক মুসলিম হলে ৫৮ জন এবং শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ৭৫ জন প্রার্থী রয়েছেন।

এ ছাড়া রোকেয়া হলে ৪৫ জন, সূর্যসেন হলে ৭৫ জন, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ৬০ জন, শামসুন নাহার হলে ৩৫ জন, কবি জসীম উদ্দীন হলে ৬৮ জন, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ৭৩ জন, শেখ মুজিবুর রহমান হলে ৫৯ জন এবং শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ৩৬ জন প্রার্থী চূড়ান্ত হয়েছেন।

অন্যদিকে অমর একুশে হলে ৭৬ জন, কবি সুফিয়া কামাল হলে ৩৮ জন, বিজয় একাত্তর হলে ৬৮ জন এবং স্যার এ এফ রহমান হলে ৬২ জন প্রার্থী রয়েছেন।

১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৩৭ বার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের নির্বাচনে ভিপি হন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নুরুল হক নুর। তিনি এখন গণঅধিকার পরিষদ নামের রাজনৈতিক দলটির সভাপতি। জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) গোলাম রাব্বানী। ওই নির্বাচন হয়েছিল সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন থেকে প্রার্থী হওয়া মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মাহবুবুর জামান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকেই মনে করেন, ডাকসু নির্বাচন হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের লাভ আর না হলে যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের ছাত্র সংগঠনের লাভ। বিএনপির সময়ে কোনো ডাকসু নির্বাচন হয়নি। আওয়ামী লীগের সময়ে একবার হয়েছে, তাও  আবার আদালতের নির্দেশে। তবে ওই নির্বাচনও ছিল না প্রভাবমুক্ত। কিন্তু দুই শাসনামলেই বার বার ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

বামপন্থি সাতটি ছাত্রসংগঠনের উদ্যোগে গঠিত ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’। এই প্যানেলের হয়ে ভিপি পদে লড়ছেন শেখ তাসনিম আফরোজ (ইমি)।

তাসনিম আফরোজ (ইমি) বলেন, ‘যারা শাসক, তারা সবসময় চেয়েছেন তাদের অপশাসন টিকিয়ে রাখতে। এ জন্য তারা কখনোই ডাকসু বা ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাননি। তাদের ছাত্র সংগঠন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘যেমন আওয়ামী লীগের সময় একবার মাত্র ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। তা-ও আদালতের নির্দেশে। কিন্তু তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ঠিকই সবকিছু দখল করেছিল। অন্য ছাত্র সংগঠনকে কাজ করতে দেয়নি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার বলতে কিছু ছিল না।’

ডাকসুর এক ভিপি প্রার্থী শামীম হোসেন বলেন, ‘স্টুডেন্টস অটোনমি’র কথা। তার মতে, ‘ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অটোনমি প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্যাম্পাসভিত্তিক স্বতন্ত্র ছাত্র রাজনীতি গড়ে উঠবে। দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি কোণঠাসা হয়ে পড়বে।’

ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত হলে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে বলে মনে করেন অনেকে। তবে এই ধারণার সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন ডাকসুর সাবেক ভিপি ও জাতীয় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। 

তিনি বলেন, ‘জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার একটি বড় ফ্যাক্টর হলো সময় ও পরিস্থিতি। ডাকসু থেকে যে নেতৃত্ব তৈরি হয়নি, তা নয়। তবে যেভাবে বলা হয়, সেভাবে নয়। বড় বড় আন্দোলনে ছাত্ররা এগিয়ে থেকেছে। তারা নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে সেভাবে পরবর্তীতে বড় ধরনের ভূমিকায় খুব বেশি নেতৃত্বকে দেখা যায়নি।’

এদিকে, ডাকসুর সাবেক জিএস খায়রুল কবির খোকন বলেন, ‘ডাকসুর নেতত্বে ছিলেন এমন অনেকেই পরে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছেন। আসলে বিষয়টি এমপি, মন্ত্রী হওয়া নয়, বিষয়টি হলো, দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভূমিকা রাখা। সেই বিবেচনায় ছাত্র নেতাদের, ছাত্রদের ভূমিকা অনেক বড়। আর তারা অনেকে সরকার পরিচালনা, সংসদ—সবখানেই ভূামকা রেখেছেন।’

তিনি বলেন, ‘আসলে ডাকসু নির্বাচন তো নিয়মিত হয় না। প্রতি বছর যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে নিয়মিত নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে। তারা শুধু রাজনীতি কেন, জাতীয় জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব দেবে।’