ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৫

প্রশিক্ষকের সামনেই ডুবেছিলেন সায়মা, উদ্ধারে লাগে ২০ মিনিট

রাবি প্রতিনিধি
প্রকাশিত: অক্টোবর ৩০, ২০২৫, ০৬:৩৫ পিএম
শিক্ষার্থী সায়মা হোসাইন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সায়মা হোসাইন সুইমিংপুলের পানির নিচে ছিলেন প্রায় ২০ মিনিট। সেখানে তাকে উদ্ধারের জন্য কোনো প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মী উপস্থিত ছিলেন না। পুলের পাড়ে থাকা দুই প্রশিক্ষক নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলেন। বিষয়টি নজরে আসার পর তারা বাইরে থেকে ছাত্রদের ডেকে এনে সায়মাকে উদ্ধার করতে বলেন। এক ছাত্র ও দুই ছাত্রী মিলে তাকে ওপরে তোলেন এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যান।

চিকিৎসকরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সায়মাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন। তবে সেখানে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা অ্যাম্বুলেন্সে ছিল না কোনো অক্সিজেন সিলিন্ডার। পরে জরুরি বিভাগ থেকে একটি সিলিন্ডার আনা হয়, কিন্তু তাতেও পর্যাপ্ত অক্সিজেন ছিল না। সেটি বদল করে গাড়ি প্রস্তুত করতে সময় লাগে আরও প্রায় ৮ মিনিট।

এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে সায়মার মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদনে। বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান, উপাচার্য অধ্যাপক মাঈন উদ্দিন, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ, জনসংযোগ কর্মকর্তা অধ্যাপক আখতার হোসেন মজুমদার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের প্রতিনিধি এবং সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী, সাতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া প্রতিটি হল দলের জন্য একজন প্রশিক্ষক থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সায়মার হল (মন্নুজান হল)–এর ক্রীড়া প্রশিক্ষকের পদটি দীর্ঘদিন ধরে শূন্য ছিল। সায়মা আনুষ্ঠানিকভাবে সাতার দলের সদস্যও ছিলেন না, তবুও তিনি সাতার প্রশিক্ষণে অংশ নিতে সুইমিংপুলে যান।

তিনি আরও জানান, সেদিন আরও দুটি হলের শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছিলেন। সেই হলগুলোর দুই প্রশিক্ষক উপস্থিত ছিলেন পুলে। তাদের সামনেই অনুশীলন চলছিল। সবাই সাতার কাটছিলেন, কিন্তু হঠাৎ সায়মা সবার অজান্তে ডুবে যান। বিষয়টি বুঝতে পেরে তাকে তুলতে সময় লেগেছে প্রায় ২০ মিনিট। ওপরে তোলার পর তার বুকে চাপ দিয়ে পানি বের করার চেষ্টা করা হয়, তবে তার মুখ দিয়ে পানি ও খাবার বের হচ্ছিল।

সায়মার শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ছিল বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সায়মা নিয়মিত ইনহেলার ব্যবহার করতেন এবং এর জন্য চিকিৎসা নিয়েছিলেন বিভিন্ন সময়ে।

প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রশিক্ষক ও উপস্থিত শিক্ষার্থীদের সামনেই একজন শিক্ষার্থী ডুবে যাওয়া এবং তা এত দীর্ঘ সময় নজরে না আসা প্রশিক্ষকদের দায়িত্বে গাফিলতির প্রমাণ। দুই প্রশিক্ষক নিজেরা গল্প করছিলেন, ফলে ঘটনাটি তাদের চোখ এড়িয়ে যায়। এজন্য তদন্ত কমিটি দুই প্রশিক্ষককে তাদের পদ থেকে প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি সুইমিংপুলে একজন স্থায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রের জরুরি বিভাগের কর্মীরা অক্সিজেন ব্যবহারে অনভিজ্ঞ ছিলেন। সিলিন্ডারে পর্যাপ্ত অক্সিজেন আছে কিনা, সে বিষয়ে তাদের ধারণা ও চর্চার অভাবের কারণে মূল্যবান সময় নষ্ট হয়েছে। যদিও ডাক্তার, নার্স ও কর্মকর্তারা সায়মাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন সর্বোচ্চভাবে। জরুরি বিভাগে কর্মরতদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করারও সুপারিশ করেছে কমিটি।

শিক্ষক হেনস্তার অভিযোগে শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জন

প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় প্রশ্ন করতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আমিনুল ইসলামকে হেনস্তা করা হয়েছে— এমন অভিযোগে সিনেট ভবনেই স্লোগান শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। পরে তারা প্রশাসন ভবন তালাবদ্ধ করে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করছিলেন এবং অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবিতে ক্লাস বর্জন ও আমরণ অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

অভিযুক্ত কর্মকর্তারা হলেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল ইসলাম মাসউদ, প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা অধ্যাপক আখতার হোসেন মজুমদার।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সিনেট ভবনে তাদের বিভাগের শিক্ষককে প্রশ্ন করতে বাধা দেন ও হেনস্তা করেন উল্লিখিত কর্মকর্তারা। তারা দাবি করেন, অভিযুক্তদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার ও সায়মার মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে একাধিকবার কল করা হলেও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ও জনসংযোগ কর্মকর্তা সাড়া দেননি।

প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ওই শিক্ষকের এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকই ভালো বলতে পারবেন তার সঙ্গে এমন কিছু ঘটেছে কি না।’

এর আগে গত ২৬ অক্টোবর বিকেলে সায়মার আকস্মিক মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন। উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রাথমিক তদন্তের আশ্বাস দিলে শিক্ষার্থীরা সেদিনের আন্দোলন স্থগিত করেন।

পরে তিন দিন ধরে প্যারিস রোডে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন তারা। কিন্তু তিন দিন পেরিয়ে গেলেও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়ায় বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে তারা প্রশাসন ভবনের সামনে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন।