ঢাকা শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

৪ বছরেও অবসরভাতা পাননি ৮৮ হাজার শিক্ষক

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৫, ০৯:০৬ এএম
শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষিকা। ছবি- সংগৃহীত

শিক্ষাজীবনে একটি প্রজন্মকে গড়ে তোলার পেছনে নিরলস শ্রম দিয়েছেন তারা। কিন্তু আজ সেই শিক্ষকরা- যারা এক সময় ছিলেন সমাজের আলোকবর্তিকা- অবসরের পর নিজেদের ন্যায্য প্রাপ্য ভাতা পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষায়। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮৮ হাজার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারী এখন অবসর ও কল্যাণ সুবিধা না পেয়ে চরম আর্থিক সংকট আর হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।

সরকারি বরাদ্দ ও প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে চার বছরেও মেলেনি কাঙ্ক্ষিত অর্থ। অথচ আদালতের নির্দেশ ছিল- অবসরের ছয় মাসের মধ্যে দিতে হবে অবসরভাতা। বাস্তবতা হচ্ছে, সেই নির্দেশও এখন কাগজে-কলমে বন্দি। ফলে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে বৃদ্ধ বয়সে চিকিৎসা, পারিবারিক খরচ কিংবা ন্যূনতম জীবনযাপনেও হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষকরা।

৯ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি, বরাদ্দ মাত্র ২২০০ কোটি

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ সুবিধা প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত অবসর সুবিধা বোর্ড এবং কল্যাণ ট্রাস্ট জানিয়েছে, বর্তমানে পেন্ডিং আবেদন নিষ্পত্তিতে প্রয়োজন প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। তবে সরকার সম্প্রতি বরাদ্দ দিয়েছে মাত্র ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা- এর মধ্যে ২ হাজার কোটি বন্ড এবং ২০০ কোটি মূলধন অনুদান।

ফলে এই বরাদ্দ দিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদনকারীদের ভাতা পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষা

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই আর্থিক সংকটের কারণে আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নও সম্ভব নয়, এবং তারা বিষয়টি আইনিভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আদালতের রায়

২০২৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে বলেন, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট ছয় মাসের মধ্যে দিতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট ১৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে ২০২৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর। রায়ে বলা হয়, বছরের পর বছর শিক্ষকরা তাদের প্রাপ্য পেতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

তবে বাস্তবতা ভিন্ন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের কাছে এখন পর্যাপ্ত অর্থ নেই। ৯ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হলেও সরকার দিয়েছে মাত্র ২২০০ কোটি। তাই আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।’

আবেদন নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে অবসর সুবিধা বোর্ড ২০২১ সাল পর্যন্ত এবং কল্যাণ ট্রাস্ট ২০২২ সালের আবেদন নিষ্পত্তি করছে। গড়ে একটি আবেদন নিষ্পন্ন হতে আড়াই বছর সময় লাগছে। ২০২৫ সালের ২২ মে পর্যন্ত অবসর সুবিধা বোর্ডে ৪৫ হাজার এবং কল্যাণ ট্রাস্টে ৪২ হাজার ৬০০টি আবেদন অনিষ্পন্ন রয়েছে। এ দুটির নিষ্পত্তিতে প্রয়োজন প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা।

অন্যদিকে মাসিক ভিত্তিতে অবসর বোর্ডের চাহিদা ৬৫ কোটি টাকা, যেখানে মাসে আয় মাত্র ৫৫ কোটি। ফলে প্রতি মাসে ১০ কোটি টাকার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, যা বছরে দাঁড়ায় ১২০ কোটি টাকা।

নিজস্ব অর্থেই জমে থাকা প্রাপ্য

এই অর্থের একটি বড় অংশ আসে শিক্ষক-কর্মচারীদের নিজস্ব বেতন থেকে। অবসর সুবিধার জন্য প্রতি মাসে মূল বেতনের ৬ শতাংশ এবং কল্যাণ সুবিধার জন্য ৪ শতাংশ কেটে রাখা হয়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি বছর নেওয়া হয় ১০০ টাকা (৭০ টাকা অবসর, ৩০ টাকা কল্যাণ)। তবু চাকরি শেষের পর সেই টাকা পেতে বছরের পর বছর ঘুরতে হচ্ছে শিক্ষক-কর্মচারীদের।

মানবেতর জীবন, দুর্ভোগের শেষ নেই

মুন্সীগঞ্জের রামপাল ডিগ্রি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক কাজী আলাউদ্দিন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পায়ের চিকিৎসা করাতে চান অবসরের টাকায়। চার বছর ধরে আবেদন করেও টাকা না পেয়ে এখন লাঠিতে ভর দিয়ে চলতে হয় তাকে।

এমন দুর্ভোগে শুধু তিনি নন, ঢাকার ব্যানবেইস ভবনে প্রায়ই দেখা যায় ৭০-৮০ বছর বয়সি অসুস্থ শিক্ষকরা কাগজ হাতে অপেক্ষা করছেন, কোনো কর্মকর্তা যেন দেখা দেন! কেউ কেউ ধারদেনা করে, কেউবা সন্তানদের কাছে হাত পেতে, কেউবা জীবন সায়াহ্নে পেনশনের আশায় মৃত্যুবরণ করেছেন।

ব্যাংক সংকটেও নতুন সমস্যা

কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা লেনদেন হতো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে ব্যাংকটি তারল্য সংকটে পড়লে, ট্রাস্টের ৩০ কোটি টাকা দিতে অপারগতা জানায় প্রতিষ্ঠানটি।

শিক্ষক মর্যাদার অবমাননা

শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, এই অব্যবস্থাপনা শুধু শিক্ষক-কর্মচারীদের দুর্ভোগই বাড়াচ্ছে না, তাদের পেশাগত মর্যাদা ও সম্মানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

একজন অধ্যাপক বলেন, ‘এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে, তাহলে নতুন প্রজন্ম শিক্ষা পেশায় আগ্রহ হারাবে।’

সমাধান কোথায়?

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, এই দীর্ঘমেয়াদি সংকট সমাধানে প্রয়োজন এককালীন বিশেষ থোক বরাদ্দ। না হলে বছরের পর বছর ধরে পেনশনের জন্য অপেক্ষমাণ এই শিক্ষক-কর্মচারীদের দুর্ভোগের কোনো অবসান ঘটবে না।