ঢাকায় চলমান দুটি মেট্রোরেল প্রকল্প- এমআরটি লাইন-১ ও এমআরটি লাইন-৫ (নর্দান রুট)- নিয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চিন্তিত সরকার এখন বিকল্প পথ খুঁজছে। জাপানি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা’র সহায়তায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর প্রস্তাবিত ব্যয় দুই লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি, যা সরকারের পূর্বের প্রাক্কলনের দ্বিগুণেরও বেশি।
চোখধাঁধানো ব্যয়ের চিত্র
২০১৯ সালে সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে সরকারের প্রাথমিক প্রাক্কলন ছিল প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এমআরটি লাইন-১-এর জন্য নির্ধারিত ছিল ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি এবং এমআরটি লাইন-৫ (নর্দান রুট)-এর জন্য ৪১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। কিন্তু সাম্প্রতিক জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব অনুযায়ী এই দুই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় দাঁড়াচ্ছে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী অস্বাভাবিক।
এ পরিস্থিতিতে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল সম্প্রতি জাপান সফর করে জাইকার সঙ্গে আলোচনা করেছে। মূল উদ্দেশ্য- খরচ যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা। তবে জাইকা এখনো ব্যয় কমানোর প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
সরকার জানিয়েছে, জাইকা নির্ধারিত যৌক্তিক ব্যয়ে কাজ করতে না চাইলে উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে অন্য দেশ বা সংস্থার মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে হাঁটবে বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, ‘জাইকার নমনীয় ঋণের আড়ালে অযৌক্তিক শর্ত আরোপ প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়। দরপত্রে শুধু জাপানি কোম্পানিগুলো অংশ নিতে পারে বলে প্রতিযোগিতা থাকে না। এতে সিন্ডিকেট করে তারা চড়া দর হাঁকায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি কিলোমিটারে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় বিশ্ব রেকর্ড হতে পারে। এটি শ্বেতহস্তীতে পরিণত হবে এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক চাপ বাড়াবে।’
ভারত-ভিয়েতনামে কম ব্যয়, ঢাকায় চড়া দামে
ডিএমটিসিএলের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি কিলোমিটারে মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় হয় ৫০০ কোটি টাকার কম, যেখানে ভিয়েতনাম, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, এমনকি অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশেও তুলনামূলক কম খরচেই মেট্রো নির্মাণ হচ্ছে। অথচ ঢাকায় খরচ প্রায় ৬ গুণ বেশি। এর পেছনে দর কষাকষিতে দুর্বলতা এবং একচেটিয়া শর্ত আরোপকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকারের করণীয়
জাপানে প্রতিনিধিদলের সফরের পর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি অন্যান্য দেশের মেট্রো প্রকল্পের খরচ বিশ্লেষণ করে একটি যৌক্তিক প্রস্তাব তৈরি করবে এবং জাইকাকে তা উপস্থাপন করা হবে। এতে সম্মতি না পেলে সরকার জাইকার বিকল্প খুঁজবে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে ব্যয় কিছুটা বেড়েছে, যা স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান প্রস্তাবিত ব্যয় যৌক্তিকতার সীমা ছাড়িয়েছে। আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে থেকেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।’
লক্ষ্য ও নির্মাণ
সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর মধ্যে লাইন-৬ (উত্তরা থেকে কমলাপুর) বর্তমানে কার্যত শেষের পথে। নির্মাণাধীন বাকি দুটি লাইন- লাইন-১ (কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর ও পূর্বাচল) এবং লাইন-৫ (হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা)- এর কাজ এখন শুরু হচ্ছে, যদিও উচ্চ ব্যয়ের কারণে প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে।