দেশের জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল ‘প্র্যাঙ্ক কিং’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক সজীব উদ্দিন ওরফে পরিচালক আর্থিক সজীব এবং অভিনেত্রী শায়লা সাথীর বিরুদ্ধে একাধিক অনৈতিক ও অপেশাদার আচরণের অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগে বলা হচ্ছে, বিবাহিত ও দুই সন্তানের পিতা সজীব একসময় ঢাকায় বসবাস করছিলেন অভিনেত্রী শায়লা সাথীর সঙ্গে ‘লিভ টুগেদার’ হিসেবে, যখন তার স্ত্রী ও সন্তানরা অবস্থান করছিলেন গ্রামের বাড়িতে। পরে সজীব-সাথীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক জানাজানি হলে, তার স্ত্রী বর্তমানে ঢাকা চলে আসেন। তবে স্ত্রী ঢাকায় থাকার চেষ্টা করলেও সজীব ও শায়লার সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা কমেনি, বরং তারা এখন ‘প্র্যাঙ্ক কিং’-এর অফিস রুম কিংবা শায়লার বাসায় একান্ত সময় কাটান বলে ঘনিষ্ঠ সূত্র রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছে।
পাশাপাশি কাজের সুযোগের আশ্বাস দিয়ে নারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে সজীবের বিরুদ্ধে। এছাড়া পুরনো সদস্যদের অবমূল্যায়ন এবং শায়লার একচ্ছত্র প্রভাবের মাধ্যমে পুরো টিম পরিচালনার অভিযোগও এসেছে প্রাক্তন সদস্যদের পক্ষ থেকে।
সূত্র জানায়, যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে আর্থিক সজীব ভর্তি হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে। মূলধারার নাটকে কাজ করার আগ্রহে তিনি ঢাকায় আসেন এবং ছোট-বড় কয়েকটি প্রজেক্টে কাজের চেষ্টা করেন। তবে কাঙ্ক্ষিত সুযোগ না পাওয়ায় তিনি নিজেই ইউটিউবে কনটেন্ট তৈরি শুরু করেন। সেই লক্ষ্যেই চালু করেন ‘প্র্যাঙ্ক কিং’ নামের একটি চ্যানেল। শুরুর দিকে প্র্যাঙ্ক ভিডিও বানালেও পরে নাটকধর্মী কনটেন্ট নির্মাণে মনোনিবেশ করেন।
তবে অভিযোগ রয়েছে, কাজের সুযোগের আশ্বাস দিয়ে আর্থিক সজীব একাধিক নারী সহকর্মীর সঙ্গে অনৈতিক ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। টিমের সদস্য শায়লা সাথীর সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা আলোচনা চলছিল।
অভিযোগ রয়েছে, এই সম্পর্কের জেরেই চ্যানেল থেকে অনেক পুরনো ও গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়। তাদের মধ্যে আছেন তিথি, তামিম, মামুনুর রশিদ, ফারুক, সিয়াম, সাগর মির্জা এবং সজীবের আত্মীয় সামিয়াও।
অভিযোগের বিষয়ে ‘প্র্যাঙ্ক কিং’-এর সাবেক সদস্য ও অভিনেত্রী তিথিও একটি শোতে মুখ খুলেন। সেখানে তিনি আর্থিক সজীব ও শায়লা সাথীর বিরুদ্ধে অনৈতিক আচরণ, টিম থেকে সদস্যদের বাদ দেওয়া এবং কাজের পরিবেশ নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন।
একাধিক প্রাক্তন সদস্য জানিয়েছেন, শুরুর দিকে তারা বিনা পারিশ্রমিকে পরিশ্রম করলেও পরবর্তীতে চ্যানেল থেকে আয় শুরু হলে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। এমনকি শুটিং চলাকালীন খাবারের ব্যবস্থাও করা হতো না বলে অভিযোগ তাদের।
ঘনিষ্ঠ সূত্র আরও জানায়, কলেজ জীবনে ‘মুক্তি’ নামে এক তরুণীর সঙ্গে আর্থিক সজীবের প্রেমের সম্পর্ক ছিল, যা ভেঙে যাওয়ার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন মুক্তি। পরবর্তীতে ওই তরুণীর মৃত্যু ঘটে, যার পর চার মাস আত্মগোপনে ছিলেন সজীব। যদিও এই অভিযোগের সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
সূত্র মতে, আর্থিক সজীবের বিবাহিত জীবন প্রায় ছয় থেকে সাত বছরের। স্ত্রী দুই সন্তানসহ আগে গ্রামে থাকলেও বর্তমানে স্বামীর ব্যক্তি জীবনে চলমান সম্পর্ক ও বিতর্কের কারণে তিনি ঢাকায় থাকছেন।
ঘনিষ্ঠদের দাবি, এই পরিস্থিতি সজীবের পরিবারের মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছে। যদিও স্ত্রী প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি।
জানা গেছে, তাদের ছেলে সন্তানের বয়স আনুমানিক পাঁচ বছর এবং মেয়ে সন্তানের বয়স দুই বছর।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, আর্থিক সজীব ও শায়লা সাথীকে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে— উত্তরা, ৩০০ ফিট, পুরান ঢাকা ইত্যাদি এলাকায় ঘনিষ্ঠভাবে একত্রে দেখা গেছে।
এছাড়া ঘনিষ্ঠ সূত্রের মাধ্যমে পাওয়া একাধিক স্ক্রিনশটে তাদের ব্যক্তিগত আলাপ এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ওই স্ক্রিনশটগুলোতে দেখা যায়, আর্থিক সজীবের ফেসবুক প্রোফাইলের পাশে ব্লু ভেরিফায়েড চিহ্ন রয়েছে, যা প্রোফাইলটির সত্যতা নিশ্চিত করে।
আরও অভিযোগ রয়েছে, শায়লা সাথী টিমে তার সমবয়সী বা সামান্য সিনিয়র নারী সহকর্মীদের উপস্থিতি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না।
ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, তিনি মনে করেন এমন কেউ থাকলে তার প্রভাব খর্ব হতে পারে। ফলে চ্যানেলের পুরনো নারী সদস্যদের কেউ কেউ ফিরতে চাইলেও তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অথচ সেই সদস্যরাই একসময় চ্যানেলটির জনপ্রিয়তা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
‘প্র্যাঙ্ক কিং’-এর অন্যতম পুরনো সদস্য এবং আর্থিক সজীবের ভাগ্নি সামিয়া সুলতানা দুই মাস আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি স্ট্যাটাসে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, অতীত প্রেম ঘটনার পরিণতি এবং নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
সামিয়ার দাবি অনুযায়ী, ওই ঘটনার জেরে সজীব তার বাসায় গিয়ে হত্যা করার হুমকি দেয় বলে অভিযোগ ওঠে। পরবর্তীতে সামিয়া মিরপুর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
অন্যদিকে, শায়লা সাথী নিজেকে ‘সিঙ্গেল’ দাবি করলেও তিনি আসলে ডিভোর্সি, এমন দাবি করেছে কয়েকজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী।
ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, তাদের গ্রামের দুইজন ব্যক্তি ফেসবুকে একটি পোস্টের মন্তব্যে শায়লার বৈবাহিক অবস্থা প্রকাশ করেন, যার স্ক্রিনশট ঘনিষ্ঠ সূত্র সরবরাহ করেছে।
ঘনিষ্ঠ সূত্রের মাধ্যমে আমাদের কাছে অর্ধ শতাধিক কথোপকথনের স্ক্রিনশট এসেছে।
স্ক্রিনশট অনুযায়ী, আর্থিক সজীবের একাধিক নারীসঙ্গ, শারীরিক সম্পর্ক এবং টিমের সদস্যদের প্রতি অনৈতিক আগ্রহ স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
ওই স্ক্রিনশটগুলোতে দেখা যায়, তিনি একাধিক নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন বলে স্বীকার করছেন, এমনকি ‘থ্রিসাম’-এর মতো কুরুচিপূর্ণ ইচ্ছার কথাও প্রকাশ করেছেন। এছাড়া টিমের সদস্য ও বাইরের মেয়েদের কাজের সুযোগ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রমাণও মিলে স্ক্রিনশটগুলোতে।
শুধু কথোপকথন নয়, শায়লা সাথীর গলায় সজীবের দেওয়া ‘লাভ বাইট-এর ছবিও সরবরাহ করেছে সেই সূত্র, যা তাদের ঘনিষ্ঠতার ভিজ্যুয়াল প্রমাণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। স্ক্রিনশটগুলোর একটি ভিডিও রেকর্ডিং সূত্র সরবরাহ করেছে, যা থেকে বোঝা যায় স্ক্রিনশটগুলো আসল এবং সম্পাদিত নয়। ফলে বিষয়টির সত্যতা নিয়ে সংশয় থাকছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত দুইজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে আর্থিক সজীব রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এ সব কিছু মিথ্যা কথা। ও (শায়লা সাথী) আমার ছোট বোন। আমার টিমেই কাজ করে। মানুষ উল্টাপাল্টা ছড়াচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আমার অ্যাকশন নেওয়া হয়েছে। আমি আইনের সহযোগিতা নিচ্ছি। এর আগে জিডি করা হয়েছে। আমি ফ্রি হয়ে কেস করব। এগুলো মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে অভিনেত্রী শায়লা সাথী অভিযোগগুলোকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন।
তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘কিছু কুচক্রী মহল ভাইরাল হওয়ার জন্য এসব গুজব ছড়াচ্ছে। স্ক্রিনশট বানানো, মিথ্যা গল্প ছড়ানো হচ্ছে। আমি পাঁচ বছর ধরে সততার সঙ্গে কাজ করছি। কেউ যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমার নাম নিয়ে ভাইরাল হতে চায়, আমি তাতে উৎসাহ দিতে চাই না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি কাউকে টিম থেকে বের করে দিইনি। কেউ নিজের ইচ্ছায় বের হয়েছে। আমি আমার কাজের জায়গায় নিষ্ঠাবান ও পেশাদার। ব্যক্তি আক্রমণের মাধ্যমে যারা ভাইরাল হতে চাইছে, তাদের বিরুদ্ধে আমি আইনি পদক্ষেপ নেব।’
অতীতের বিয়ে ও ডিভোর্স প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাথী বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমি একজন শিল্পী এবং শুধু আমার কাজ নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী।’
‘প্র্যাঙ্ক কিং’ ইউটিউব চ্যানেলটি এক সময় উদ্ভাবনী কনটেন্ট ও টিমওয়ার্কের জন্য আলোচনায় ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা এবং অনৈতিকতার অভিযোগে এখন এটি তীব্র বিতর্কের মুখে পড়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :