আজ ১৩ অক্টোবর- এটি ক্যালেন্ডারের একটি সাধারণ তারিখ হয়তো, কিন্তু সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে এই দিনটির একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। ১৯৪৮ সালের এই দিনেই পৃথিবী পেয়েছিল এমন এক কণ্ঠস্বর, যিনি শুধু গান গাইতেন না, আত্মার গভীরতম স্তর থেকে ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলতেন সুরের মাধ্যমে। তিনি উস্তাদ নুসরাত ফতেহ আলী খান- সুফি সংগীতের ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, যিনি আজও আমাদের আত্মায় অনুরণিত হন।
জন্ম যেখানে সুরের ভেতর
নুসরাত ফতেহ আলী খানের জন্ম পাকিস্তানের পাঞ্জাবের লায়লপুরে (বর্তমানে ফয়সালাবাদ), এক ঐতিহ্যবাহী সংগীত পরিবারে। তার পরিবার ছিল ‘কাওয়াল বাচ্চন’ গোষ্ঠীর উত্তরসূরি- যারা প্রায় ছয় শতাব্দী ধরে সুফি কাওয়ালির সেবা করে আসছেন। পিতা উস্তাদ ফতেহ আলী খান নিজেও ছিলেন প্রথিতযশা কাওয়াল, সংগীততত্ত্ববিদ ও শিক্ষক।
তবে শৈশবে নুসরাতের সংগীতজীবনে প্রবেশের পথটা খুব সহজ ছিল না। তার বাবা চাইতেন তিনি ডাক্তার হোক- একটি ‘সম্মানজনক’ পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুক। কারণ সেই সময় কাওয়ালির সামাজিক মর্যাদা ছিল নিচুস্তরের। কিন্তু নিয়তির টান ছিল প্রবল। সুর যেন জন্ম থেকেই নুসরাতের আত্মার ভাষা হয়ে উঠেছিল।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর পরিবারের কাওয়ালি দলের নেতৃত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে। এত অল্প বয়সে এত বড় দায়িত্ব- যা সাধারণত কারও পক্ষে সামলানো কঠিন। কিন্তু নুসরাত সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন আত্মবিশ্বাস আর অসাধারণ প্রতিভা দিয়ে। ধ্রুপদী সংগীতের গঠন, সুফি কবিতার ভাব ও আধ্যাত্মিকতা- সব মিলিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন এক ভিন্ন ধারার কাওয়ালি, যা শোনা মানেই যেন আত্মার এক গোপন দরজা খোলা।
কণ্ঠ যেন সাগরের মতো
নুসরাত ফতেহ আলী খানের কণ্ঠ ছিল স্রেফ ‘ভালো’ নয়- তা ছিল এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা। বিশেষজ্ঞদের মতে, তার কণ্ঠস্বরের রেঞ্জ ছয় অক্টেভ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল- যা বিশ্বে বিরল। তার গান ধীরে ধীরে শুরু হতো, যেন এক গোপন প্রার্থনা, তারপর হঠাৎ এক আত্মিক বিস্ফোরণে ভরিয়ে দিত মঞ্চ, শ্রোতা এবং আকাশ। তার কাওয়ালি ছিল শরীরের নাচ নয়- আত্মার নাচ।
১৯৭০-এর দশকে রেডিও পাকিস্তানে গাইতে গাইতে নুসরাত হয়ে ওঠেন ঘরের নাম। কিন্তু বিশ্ব তাকে চিনতে শুরু করে ১৯৮৫ সালে WOMAD (World of Music, Arts and Dance) ফেস্টিভালে। এরপর পিটার গ্যাব্রিয়েল-এর সঙ্গে কাজ, পশ্চিমা অ্যালবাম Mustt Mustt, Night Song ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি কাওয়ালিকে নিয়ে যান ইউরোপ ও আমেরিকার শ্রোতার হৃদয়ে।
তিনি দেখিয়ে দেন, সঙ্গীতের কোনো ধর্ম, দেশ, ভাষা নেই- এটি কেবল অনুভবের, আত্মার।
সুফিবাদের সুরসাধক
নুসরাতের কাওয়ালির মূল শক্তি ছিল সুফি দর্শনের প্রতি তার গভীর অন্তর্জ্ঞান ও ভালোবাসা। তিনি রুমি, বুল্লে শাহ, হাফিজ, আমির খসরুর কবিতা এমন আবেগে গাইতেন, যেন সেই শব্দগুলো তার নিজের হৃদয় থেকে জন্ম নিচ্ছে। তার গান শোনার সময় মনে হতো- এটা স্রেফ সংগীত নয়, এক আধ্যাত্মিক ধ্যান, এক ভালোবাসার সাধনা।
‘আল্লাহ হু’, ‘তাজদার-এ-হারাম’, ‘মস্ত মস্ত’, ‘দম মস্ত কলন্দর’, ‘তুমি দিল্লী ওয়ালে’- এসব গান শুধুই হিট ছিল না, এগুলো হয়ে উঠেছিল প্রজন্মের পর প্রজন্মের প্রার্থনা। তার গান যখন বাজে, তখন ধর্ম ভুলে মানুষ কাঁদে, হাসে, ভালোবাসে।
নুসরাত জীবনের শেষ দশকে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি বড় শহরে পারফর্ম করেন। তার রেকর্ডকৃত গানের সংখ্যা ১০০০-র বেশি, এবং গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে তার নাম রয়েছে সর্বোচ্চ রেকর্ডকৃত কাওয়াল শিল্পী হিসেবে।
জন্মদিনে শ্রদ্ধা
অবিরাম সংগীতচর্চা, ভ্রমণ আর শরীরের অবসাদ একসময় তাকে অসুস্থ করে তোলে। কিডনি ও লিভার জটিলতায় তিনি ১৯৯৭ সালের ১৬ আগস্ট লন্ডনের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স তখন মাত্র ৪৮ বছর। সঙ্গীত জগৎ হারায় এক অমর কণ্ঠকে।
তবে সত্যিকারের শিল্পীরা কখনো চলে যান না। আজও তার গান শোনা মানে এক প্রকার আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। তার কণ্ঠ আজও বাজে সিনেমায়, মঞ্চে, ইউটিউব- একইরকম আবেগে, একইরকম আলোয়।
আজ তার জন্মদিনে তাকে স্মরণ করা মানে কেবল একজন শিল্পীকে স্মরণ করা নয়। এটা এক আত্মিক যাত্রায় শামিল হওয়া, যেখানে সুরের মধ্য দিয়ে আমরা স্পর্শ করি অনন্তকে। তিনি প্রমাণ করেছিলেন- ভালোবাসা, প্রার্থনা আর সঙ্গীত- এই তিনটি একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন