ঢাকা শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

যে কারণে সালমান শাহ আজও চির আধুনিক

বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৫, ০৪:১৮ পিএম
অভিনেতা সালমান শাহ। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

আজ ১৯ সেপ্টেম্বর, বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি বিশেষ দিন। এই দিনে জন্মেছিলেন সালমান শাহ, যাকে অনেকে বলেন নব্বইয়ের দশকের পর্দার রাজপুত্র। মাত্র চার বছরের ক্যারিয়ার, অথচ তার জনপ্রিয়তা আজও অমলিন। মৃত্যুর প্রায় তিন দশক পরও সালমান শাহ রয়ে গেছেন কোটি ভক্তের হৃদয়ে, এক চিরসবুজ স্বপ্নপুরুষ হয়ে।

জন্ম ও শৈশব:

১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেট শহরের দাড়িয়াপাড়ায় তার নানা বাড়ি ‘আব-এ-হায়াত’ ভবনে জন্মগ্রহণ করেন চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন। পরবর্তীতে তিনি পরিচিত হন ‘সালমান শাহ’ নামে। তার পিতা কমর উদ্দিন চৌধুরী এবং মাতা নীলা চৌধুরী। ছোটবেলা থেকেই সালমান ছিলেন সৃজনশীল ও চঞ্চল। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই হয়তো অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা ছিল গভীর।

অভিনয়ে প্রথম পদার্পণ:

সালমান শাহ অভিনয়জগতে প্রবেশ করেন টেলিভিশন নাটক ও মডেলিংয়ের মাধ্যমে। তবে ১৯৯৩ সালে সোহানুর রহমান সোহানের পরিচালনায় ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমায় অভিষেকের মাধ্যমে সালমান বাংলা সিনেমার দৃশ্যপটই পাল্টে দেন। প্রথম ছবিতেই মৌসুমীর সঙ্গে জুটি বেঁধে দর্শকদের মন জয় করেন তিনি।

ইতিহাস গড়া ক্যারিয়ার:

মাত্র চার বছরে তিনি ২৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এই অল্প সময়েই তিনি হয়ে ওঠেন এক প্রজন্মের আবেগ, বাংলা সিনেমার সবচেয়ে দামি ও জনপ্রিয় নায়ক। তার উল্লেখযোগ্য ছবির তালিকায় রয়েছে: ‘তোমাকে চাই’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘বুকের ভিতর আগুন’ ইত্যাদি।

ফ্যাশন আইকন ও টাইম ট্রাভেলার:

সালমান শাহ ছিলেন সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা একজন তারকা। পোশাক, স্টাইল, স্ক্রিন প্রেজেন্স সবকিছুতেই তিনি আলাদা। ব্যান্ডানা, গোল চশমা, জিন্স-টি-শার্ট, ব্যাকব্রাশ করা চুল—এই স্টাইল তারই হাতে বাংলা সিনেমায় প্রথম জনপ্রিয় হয়। অনেক তরুণ তার স্টাইল অনুসরণ করতেন। পরিচালকরা অনেক সময় তার ওপরই সিনেমার কস্টিউম ডিজাইনের দায়িত্ব ছেড়ে দিতেন। বলা হয়, তিনি ছিলেন বিনোদন দুনিয়ার একজন টাইম ট্রাভেলার।

অভিনয়ে সাবলীলতা:

অভিনয়ে তার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল সহজতা এবং চরিত্রে ঢুকে যাওয়ার ক্ষমতা। তার সংলাপে যেমন ছিল আবেগ, তেমনি ছিল বাস্তবতার ছোঁয়া। ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’র মতো সিনেমাগুলোয় তার অভিনয় আজও দর্শকদের হৃদয়ে গেঁথে আছে। সমালোচকরাও বলেন, পর্দায় সালমানকে দেখা মানেই ছিল নিখাদ অভিনয় উপভোগ করা।

পারিশ্রমিক ও তারকাখ্যাতি:

এদিকে শুধুই অভিনয় নয়, সালমান শাহ ছিলেন এক দুর্দান্ত তারকা। তার জনপ্রিয়তা তাকে দেশের সবচেয়ে দামি নায়ক বানিয়ে তোলে। প্রথম সিনেমায় তিনি পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন মাত্র ২৫ হাজার টাকা। এরপর জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে তা বাড়তে থাকে। ‘তুমি আমার’ ছবির জন্য তিনি নেন ১ লাখ, ‘দেনমোহর’-এ ১.৫ লাখ এবং সর্বশেষ ‘বুকের ভিতর আগুন’-এর জন্য ১০ লাখ টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন। ৯০ দশকের সিনেমাপাড়ায় এটি ছিল বিশাল অংক।

সিনেমার সবচেয়ে প্রভাবশালী জুটি:

সালমান শাহ এবং শাবনূর ছিলেন নব্বই দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্দা জুটি। তাদের একসঙ্গে ১৪টি ছবিতে দেখা গেছে। ‘তোমাকে চাই’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’—এ ছবিগুলোয় তাদের রসায়ন দর্শকদের মুগ্ধ করত। দর্শকরা বিশ্বাস করতেন, তারা হয়তো বাস্তবেও প্রেমিক-প্রেমিকা। এমনটাই ছিল তাদের অনস্ক্রিন ম্যাজিক।

আবেগের দাপট:

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, সালমান শাহ মাত্র ২৫ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তার মৃত্যু ছিল রহস্যাবৃত, আকস্মিক ও হৃদয়বিদারক। আগের দিন মান্নার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ডাবিং স্টুডিওতে। মান্না তাকে ঝুঁকিপূর্ণ শট না নিতে বলেছিলেন, আর তিনি জবাবে বলেছিলেন, ‘ঝুঁকি নেব না আর, ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ সেই কথাই হয়ে ওঠে শেষ কথা।

তার মৃত্যুর পরও মুক্তি পায় কিছু ছবি। যেমন ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘স্বপ্নের নায়ক’। এই সিনেমাগুলো দেখে দর্শকেরা বুঝতে পারেন, তারা কী হারিয়েছেন। অনেক অসমাপ্ত ছবিও ছিল। যেমন ‘প্রেম পিয়াসী’, ‘বুকের ভিতর আগুন’। ডামি অভিনেতা দিয়ে শেষ করা হয় ছবিগুলো। তবে দর্শক জানে, ছায়ার আড়ালে তখনো ছিলেন সালমান শাহ।

প্রজন্ম বদলেছে, সময় এগিয়েছে, কিন্তু কমেনি সালমান শাহকে ঘিরে মানুষের ভালোবাসা। আজকের তরুণরাও ইউটিউবে তার ছবি খুঁজে দেখে, স্টাইল অনুসরণ করে, তার জীবন নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে। এমনকি সামাজিক মাধ্যমে তাকে নিয়ে ট্রেন্ড তৈরি হয়।