ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক বছর হতে চলল। কিন্তু এখনো এটুপি (অ্যাপ্লিকেশন টু পারসন) এসএমএসে সওয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র ও তার আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভূত। তার আশীর্বাদপুষ্ট প্রতিষ্ঠান ইনফোজিলিয়নকে এখনো ৫ পয়সা করে দিয়ে যেতে হচ্ছে এটুপি এসএমএস সেবা প্রদানকারী এগ্রিগেটরদের। একে এগ্রিগেটররা ‘স্রেফ চাঁদাবাজি’ বলছেন।
প্রতিটি এটুপি এসএমএসের জন্য ইনফোজিলিয়ন টেলিটক বিডি লিমিটেড পায় ৫ পয়সা। প্রযোজ্য কর আরোপের পর যেটি দাঁড়ায় ৬ পয়সা। প্রায় বিনা কারণে ইনফোজিলিয়নকে এই অর্থ দিতে হয় বলে অভিযোগ এটুপি এসএমএস সেবা প্রদানকারী এগ্রিগেটরদের। তারা বলছেন, এগ্রিগেটরদের চাপ দিয়ে এতে বাধ্য করান বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসি) সাবেক চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার।
এগ্রিগেটররা প্রতিবাদ করলে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র ও তার আইসিটিবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম করে তাদের লাইসেন্স বাতিলের হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও এখনো রমরমা ইনফোজিলিয়নের ৫ পয়সার ব্যবসা, যেটিকে চাঁদাবাজি বলছেন এগ্রিগেটররা।
অপারেটর পরিবর্তন করলেও আগের নম্বরে আসা ফোনকল নতুন নম্বরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাওয়ার সুবিধার নাম মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি (এমএনপি)। এ জন্য ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইনফোজিলিয়নকে এমএনপি লাইসেন্স দিয়েছিল বিটিআরসি। ২০১৮ সালের অক্টোবরে আনুষ্ঠানিকভাবে এমএনপি সেবা চালু করে ইনফোজিলিয়ন। অবশ্য এমএনপি লাইসেন্সের আড়ালে ইনফোজিলিয়নকে ‘ডিপিং’ নামে আরও একটি সেবার অনুমোদনও দেওয়া হয়।
এই ‘ডিপিং’সেবার নামেই দেশের অভ্যন্তরে আদান-প্রদান হওয়া সব এটুপি এসএমএস থেকে ৫ পয়সা (ভ্যাট ছাড়া) করে পায় ইনফোজিলিয়ন। যেমন কোনো ব্যাংক তার গ্রাহকদের নিজের নামে ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) বা প্রচারণামূলক এসএমএস পাঠাবে, যেটিকে বলা হয় ‘মাস্কিং এসএমএস’। এ জন্য এটুপি এগ্রিগেটরদের ব্যাংক ৫০ থেকে ৫৫ পয়সা দেবে, যার ৫ পয়সা পাবে ইনফোজিলিয়ন। ব্যাংক নিজের নামে নয় বরং শুধু নম্বর উল্লেখ করে এই এসএমএস পাঠালে সেটি হবে ‘নন-মাস্কিং এসএমএস’। এর চার্জ ৩০ থেকে ৩৫ পয়সা। এখান থেকেও ইনফোজিলিয়ন পাবে ৫ পয়সা। এটুপি ব্যবসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে গড়ে প্রতিদিন দেড় কোটি থেকে পাঁচ কোটি পর্যন্ত এমন এসএমএস লেনদেন হয়। দিনে ৫ কোটি গড় হিসেবে ইনফোজিলিয়নের মাসে ৮ কোটি ৬০ লাখ টাকার বেশি আয়ের সুযোগ রয়েছে।
এটুপি এসএমএসে ইনফোজিলিয়নের প্রাসঙ্গিকতা
অপারেটর পরিবর্তন করা ব্যবহারকারীরা এমএনপি ফোনকলের মতো যেন এসএমএসও পান, সে জন্য প্রাসঙ্গিকতা আসে ইনফোজিলিয়নের। এটুপি এগ্রিগেটররা বলছেন, ২০১৮ সালে এমএনপি চালু হওয়ার পরেও ফোনকলের মতোই এসএমএসও পাচ্ছিলেন অপারেটর পরিবর্তনকারী ব্যবহারকারীরা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছিল ‘মাস্কিং’ এসএমএস নিয়ে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার পাঠানো এসএমএস ‘মাস্কিং’ না হলে ব্যবহারকারী এসএমএসটির যথার্থতা নিয়ে বিভ্রান্ত হতে পারেন। এই অজুহাত দেখিয়ে মধ্যস্বত্বা হিসেবে আনা হয় ইনফোজিলিয়নকে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে শুধু অপারেটর পরিবর্তন করা নম্বরই নয়, সব এটুপি এসএমএসেই ৫ পয়সা করে দিতে হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘মাস্কিং’ সমস্যারও কোনো সমাধান করতে পারেনি ইনফোজিলিয়ন। যদিও এ জন্য বিটিআরসিকে দায়ী করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাধ্য করা হয় এগ্রিগেটরদের
২০২১ সালের মে মাসের আগে এগ্রিগেটররা বিটিআরসির নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। এটুপি এসএমএস সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকাভুক্তির নির্দেশিকা জারি করে এগ্রিগেটরদের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেয় বিটিআরসি। এই নির্দেশিকার অনুচ্ছেদ ১৯.২ অনুযায়ী, সব এমএনও, আইপিটিএসপি (আইপি টেলিফোন) এবং পিএসটিএন (ল্যান্ডলাইন) তথা একত্রে এএনএস অপারেটররা সনদধারী এগ্রিগেটরকে সরাসরি সংযোগ প্রদান করবে, কোনো তৃতীয় পক্ষ বা অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের নামে নয়। তবে এএনএস অপারেটররা যেন ইনফোজিলিয়নকে সংযোগ দেয়, সে জন্য নিজেদের এই নির্দেশিকা পরিবর্তনে বেশি সময় নেয়নি বিটিআরসি। পরিবর্তিত নির্দেশিকায় এই অনুচ্ছেদই রাখা হয়নি।
ইনফোজিলিয়নকে এই সুবিধা দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে ওই বছরের ডিসেম্বরে বিটিআরসিতে চিঠি দেয় এগ্রিগেটরদের সংগঠন এসএমএস অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা সিসপাব। চিঠির ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘নতুন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হলে শুধু একটি কোম্পানি (ইনফোজিলিয়ন) বিশেষ সুবিধা পাবে, অন্যদিকে পুরো এটুপি এসএমএস খাত ঝুঁকির মুখে পড়বে। সেবার মান হ্রাস পাবে, গ্রাহকের খরচ বাড়বে।’ শুধু একটি কোম্পানিকে সুবিধা দিতে এতগুলো প্রতিষ্ঠানকে কেন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হবে- নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে এমন প্রশ্নও রাখে সিসপাব।
চিঠির এই অংশের কারণে তখন বেজায় ক্ষিপ্ত হন তৎকালীন বিটিআরসি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন আমলা শ্যাম সুন্দর শিকদার। বিটিআরসিতে এক সভায় সিসপাব নেতৃবৃন্দকে তার বলা কথার রেকর্ড এসেছে রূপালী বাংলাদেশের কাছে। এগ্রিগেটরদের উদ্দেশে ওই সভায় তিনি বলেন, ‘আপনারা নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে কতটুকু ওয়াকিবহাল, আমার সন্দেহ আছে। ইনফোজিলিয়নকে একটি কোম্পানি হিসেবে দেখলে হবে না। টেলিকম সেবা প্রদানে একটি নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে ইনফোজিলিয়ন। আর এটাকে দেওয়া হয়েছে আইসিটি উপদেষ্টার (সজীব ওয়াজেদ জয়) নির্দেশনাক্রমে। আপনাদের এই সাহস হয় কীভাবে? আইসিটি উপদেষ্টা এই লাইন (অনুচ্ছেদ ৬) দেখলে আপনাদের সবাইকে সেবা প্রদানের সুবিধা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য আমাকে নির্দেশনা দেবেন।’
পৃথক কথোপকথনে সিসপাব সভাপতি ফিরোজ মাহমুদকে শ্যাম সুন্দর বলেন, ‘ইনফোজিলিয়ন যে ব্যবসাটা করতেছে, সেটা আইসিটি উপদেষ্টার (জয়) আশীর্বাদে। এটা আপনাকে মাথায় রাখতে হবে। উপদেষ্টার নিজস্ব চিন্তা-চেতনায় এমএনপি তৈরি করা হয়েছে। সেখানে ইনফোজিলিয়নকে যদি প্রতিপক্ষ বানান, ইতিমধ্যে বানিয়ে ফেলেছেন।’
শ্যাম সুন্দরের সরাসরি হুমকিতে এগ্রিগেটররা ইনফোজিলিয়নের সেবা নিতে বাধ্য হয়। তবে এটুপি নির্দেশিকা অনুযায়ী, এমএনওদের সঙ্গে সরাসরি রাউটিং সুবিধা চেয়ে আবেদন করেছিল সিসপাব। কিন্তু ১৪৬টি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই সংগঠনের ন্যূনতম সেই দাবিও পূরণ করেনি বিটিআরসি। কোনো কারণ প্রদর্শন ছাড়াই ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংগঠনটির দাবি বাতিল করে কমিশন। কমিশনের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের তৎকালীন পরিচালক গোলাম রাজ্জাক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে সিসপাবের দাবি বাতিল করে ইনফোজিলিয়নকে সুবিধা দেওয়ার নির্দেশনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়। একই কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত ২০২৩ সালের ২ মে’র আরেক চিঠিতে এমএনওদের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ইনফোজিলিয়নের সঙ্গে এসএমএস প্রেরণের সংযোগ প্রতিষ্ঠা করে এগ্রিগেটরদের ৭ দিনের সময়সীমা (৬ থেকে ১২ মে) দেওয়া হয়। আর ১৬ মে থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ইনফোজিলিয়নের ৫ পয়সার ব্যবসা।
ইনফোজিলিয়নকে দেওয়া এই সুবিধার সমালোচনা করে সিসপাব সভাপতি ফিরোজ মাহমুদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘জয়ের স্বার্থে ইনফোজিলিয়নকে এমএনপি লাইসেন্স দেওয়া হয়। আর কাউকে সেটি দেওয়া হয়নি। কিন্তু তারা ব্যাবসায়িকভাবে সফল না হলে, ছোট ছোট এগ্রিগেটরদের ধরে তাদের থেকে ইনফোজিলিয়নের চাঁদাবাজির সুযোগ দেওয়া হয়। সব প্রতিযোগিতা দূর করে একটি প্রতিষ্ঠানকে নানাবিধ সুবিধা দিয়ে চোখের সামনেই এই চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে শ্যাম সুন্দরসহ বিটিআরসির কর্মকর্তা গোলাম রাজ্জাক, মাহদী আহমেদ (বর্তমানে বরখাস্ত)-সহ অনেক বড় কর্তা জড়িত ছিলেন।’ ইনফোজিলিয়নকে ৫ পয়সা দেওয়ার ফলে এসএমএস সেবায় কী উন্নতি হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে ফিরোজ বলেন, ‘কোন উন্নতিই হয়নি বরং অবনতি হয়েছে। অনেক এগ্রিগেটর বন্ধ হয়ে গেছে। এমএনপি হওয়া নম্বরে ‘মাস্কিং’ এসএমএস পাঠাতে পারছে না ইনফোজিলিয়ন। এগ্রিগেটর মাস্কিং এ ৫৫ পয়সা চার্জ নিয়ে, ৩৫ পয়সার নন-মাস্কিং সেবা দিচ্ছে।
ইনফোজিলিয়নের আগে এমএনপি নম্বরেও মাস্কিং এসএমএস যেত। তাহলে ইনফোজিলিয়ন এসে কী করল। বরং এখন সবার এসএমএস একটি চ্যানেল দিয়ে যায়। ইনফোজিলিয়নের সিস্টেম ডাউন থাকলে, পুরো দেশের এটুপি সেবা বন্ধ থাকে। আগে এগ্রিগেটরদের বিকল্প উপায়ের ব্যবস্থা ছিল’।
অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইনফোজিলিয়ন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এমএনপি আসার আগে, সেবার মান ভালো না হলেও অপারেটর পরিবর্তনের স্বাধীনতা ছিল না মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের। ইনফোজিলিয়ন ব্যবহারকারীদের সেই স্বাধীনতাই দিয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই একটি এমএনপি অপারেটর থাকে। বাংলাদেশে সেটি ইনফোজিলিয়ন, যা যথাযথ দরপত্র প্রক্রিয়ায় পেয়েছি। এমএনপি সেবার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে এবং এগ্রিগেটরদের নিয়মের মধ্যে আনতে হয়তো সাবেক চেয়ারম্যান তৎকালীন আইসিটি উপদেষ্টার (জয়) নাম নিয়েছিলেন। কিন্তু জয়ের সাথে ইনফোজিলিয়নের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি আরও বলেন, ‘এমএনপি হওয়া নম্বরে মাস্কিং এসএমএস দেওয়া যাচ্ছে না বিটিআরসির নীতিমালার কারণে। এসএমএস নির্দেশিকার ১৯.৪-এ বলা আছে, এমএনও অপারেটরগুলো শুধু অননেটে (নিজস্ব অপারেটরের নম্বরের মধ্যে) মাস্কিং সেবা প্রদান করতে পারবে।’
এ বিষয়ে বিটিআরসির বর্তমান চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী বলেন, ‘ইনফোজিলিয়নের বিষয়টি নজরে এসেছে, বিষয়টি জানি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখানে ইনফোজিলিয়নকে ১ পয়সা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে কমিশন। আর অফনেটে মাস্কিং এসএমএসের বিষয়টি নতুন গাইডলানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দুই ধরনের এসএমএস বিবেচনায় নিয়েই গাইডলাইন হচ্ছে। কাজেই নতুন গাইডলাইনের নির্দেশনা আসার পর ইনফোজিলিয়নের বিষয়টি সমাধান হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে বিটিআরসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে, অবশ্যই দেখা হবে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ জমা পড়েছে বলে জানা নেই।’
আপনার মতামত লিখুন :