চাঁদের মাটিতে নিজের নামে এক টুকরো জমি—এই ধারণা এখন আর শুধু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির অংশ নয়। বহু মানুষ সামাজিক মাধ্যমে গর্ব করে জানাচ্ছেন, তাঁরা চাঁদের জমির মালিক! অনেকে প্রিয়জনকে উপহার দিচ্ছেন চাঁদের ‘দলিল’। কিন্তু বাস্তবে কি সত্যিই চাঁদে জমি কেনা যায়? এর আইনি ভিত্তি কতটা শক্ত? আর যারা ‘জমির দলিল’ কিনে বসে আছেন—তারা কি ভবিষ্যতে চাঁদে গৃহ নির্মাণ করতে পারবেন?
চাঁদের জমি কেনা বলতে বোঝানো হয়—একটি প্রতিষ্ঠান থেকে নির্দিষ্ট অর্থ দিয়ে একটি প্লট বরাদ্দ নেওয়া এবং একটি কাগজ পাওয়া, যাতে লেখা থাকে আপনি চাঁদের নির্দিষ্ট স্থানটির মালিক। বিষয়টি রোমাঞ্চকর শোনালেও বাস্তবে এটি একটি স্মারক দলিল ছাড়া কিছুই নয়।
এ ধারণার পেছনে রয়েছেন মার্কিন নাগরিক ডেনিস হোপ। ১৯৮০ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোর্টে চিঠি দিয়ে দাবি করেন, তিনি চাঁদের মালিক হতে চান। তাঁর যুক্তি ছিল—আন্তর্জাতিক মহাকাশ চুক্তি (Outer Space Treaty, 1967) অনুযায়ী কোনো দেশ চাঁদের মালিক হতে পারে না, কিন্তু সেখানে ব্যক্তি মালিকানার বিষয়টি স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। এই আইনি ফাঁককে কাজে লাগিয়ে তিনি গড়ে তোলেন Lunar Embassy Corporation নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
এরপর থেকে তিনি একর দরে চাঁদের জমি ‘বিক্রি’ করতে থাকেন। এই জমি কিনে মানুষ পাচ্ছে একটি দলিল, একটি ম্যাপ এবং একর জমির বিবরণ। চাহিদাও কম নয়—বলা হয়, কয়েক লাখ মানুষ এই জমির মালিকানা দাবি করছেন। এমনকি শাহরুখ খান, টম ক্রুজসহ অনেক সেলিব্রেটি এই তালিকায় আছেন।
চাঁদের জমি কেনার কাগজ যাদের কাছে আছে, তারা নিজেদের ‘চাঁদের মালিক’ মনে করতেই পারেন। কিন্তু বাস্তবে এই মালিকানা আইনি বৈধতা রাখে না। কারণ, Outer Space Treaty-এর ২য় অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—‘চাঁদ বা অন্য কোনো মহাকাশ বস্তু রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনা যাবে না এবং তা কোনো রাষ্ট্র দাবি করতে পারবে না।’
যদিও চুক্তিতে ব্যক্তি মালিকানার বিষয়টি খোলাসা করা হয়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে ১৯৭৯ সালে করা হয় Moon Agreement, যেখানে বলা হয়—চাঁদের প্রাকৃতিক সম্পদ মানবজাতির অভিন্ন সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তা দাবি করতে পারবে না।
যদিও অনেক দেশ Moon Agreement-এ স্বাক্ষর করেনি, তবু জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থাই Lunar Embassy বা তাদের বিক্রি করা জমির দলিলকে বৈধ স্বীকৃতি দেয়নি।
মানুষ কেন এই জমি কিনছে?
যদিও চাঁদের জমির প্রকৃত মালিকানা এখনো কেউ পাননি, তবু এটি একধরনের ইমোশনাল গিফট আইটেম হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যেমন—ভালোবাসার মানুষকে ব্যতিক্রমী কিছু উপহার দিতে; নিজের নামের সঙ্গে ‘চাঁদের মালিক’ যুক্ত করতে; ভবিষ্যতের কল্পনায় একটি বিনিয়োগ বলে ধরে নিতে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় চমক সৃষ্টির জন্যই এটি করা হয়।
এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান ‘ক্রেডিট কার্ড’ বা ‘স্মারক বোর্ড’ আকারে জমির দলিল পাঠিয়ে ক্রেতাকে একধরনের মানসিক তৃপ্তি দেয়।
বর্তমানে চাঁদে মানুষ বসবাসের জন্য প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নেই। তবে যদি ভবিষ্যতে তা সম্ভব হয় এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ আইন সংস্কার করা হয়, তাহলে হয়তো চাঁদের জমি মালিকানার প্রশ্ন আবার আলোচনায় আসবে। তবে আজকের দিনে যেসব জমির দলিল মানুষ কিনছে, তার ওপর তখন কতটা অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে—তা নিয়ে বিশাল সন্দেহ থেকেই যায়।
চাঁদে জমি কেনা সম্ভব—এই কথাটি কাগজে-কলমে যতটা রোমাঞ্চকর, বাস্তবে ততটাই আইনি জটিলতায় ঘেরা ও অনিশ্চিত। এটি মূলত একটি স্মারক দলিল ছাড়া কিছু নয়। তাই যদি আপনি নিজের নামে চাঁদের এক একর জমি রাখতে চান, রাখতে পারেন। তবে ভবিষ্যতে সেখানে গাছ লাগাতে পারবেন, এমন আশায় যেন বুক বাঁধা না থাকে!
আপনার মতামত লিখুন :