গত দুই দিনে দেশে মোট চারবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এ নিয়ে একটি স্পষ্ট প্রশ্ন জন্মাচ্ছে- আমরা কি এক বড় বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি?
গতকাল শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০:৩৮ মিনিটে প্রথম ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলা।
এরপর আজ শনিবার (২২ নভেম্বর) সকাল ১০:৩৬ মিনিটে একই উপজেলার একই স্থানে আরও একটি ভূমিকম্প হয়। আজকে দিনের শুরুর ভূমিকম্পের রিখটার স্কেলের মাত্রা ছিল ৩.৩। এছাড়াও এদিন সন্ধ্যা ৬:০৬ মিনিটে এক মিনিটের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকায় দুইবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৩.৭ এবং ৪.৩।
সৌভাগ্যবশত, এসব ভূমিকম্প এখনো মাঝারি মাত্রার বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তবে গতকাল সকালে ঘটে যাওয়া ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ জনের মৃত্যু এবং ৩ শতাধিক মানুষ আহত হওয়ার খবর জানা গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি আমাদের উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বা কোনো বড় বিপদের আশঙ্কা রয়েছে।
গতকালের ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ঢাকার কাছে হলেও এটি পুরো নগরীকে মুহূর্তের মধ্যে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা একটি ভূমিকম্পপ্রবণ টাইম বোমার উপর ঝুঁকিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সিলেট এবং চট্টগ্রামকে ঘিরে থাকা ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোনে এমন চাপ জমা হচ্ছে যা একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটাতে সক্ষম, যার শক্তি ৮ মাত্রা পর্যন্ত হতে পারে।
আরেকটি অত্যন্ত সক্রিয় অঞ্চল হলো ডাউকি ফল্ট, যা বেশ কয়েকটি বড় ভূমিকম্পের সঙ্গে যুক্ত। ধারণা করা হয়, এটি গত সহস্রাব্দে তিনবার ফেটে গেছে, যার উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে ৮৪০, ৯২০ এবং ১৫৪৮ সালে। এছাড়াও সম্ভবত ১৮৯৭ সালের আসাম ভূমিকম্প, যার মাত্রা ৮ বা তার বেশি ছিল, সেটিরও সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গতকাল যে ভূমিকম্প হয়েছে তা দেশের ইতিহাসে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে একটি।
এর আগে, চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর দেশের অভ্যন্তরে ভূমিকম্প হয়। সেদিন দুপুর ১২:১৯ মিনিটে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলা। ঢাকার উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ছিল ১৮৫ কিলোমিটার।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট ২১টি ভূমিকম্প ঘটেছে।
এর মধ্যে গত ১৪ মাসে (২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত) ১১টি ভূমিকম্প হয়েছে। এছাড়াও, ২০২৪ সালে দেশে ১২টি ভূমিকম্প হয়। চলতি ২০২৫ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত দেশে ৭টি ভূমিকম্প ঘটেছে।
তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ৮টি সিলেটে হয়েছে। এছাড়াও দিনাজপুরে ২টি, রংপুরে ২টি, পাবনায় ১টি, কুমিল্লায় ১টি, শরীয়তপুরে ১টি, টাঙ্গাইলে ১টি, রাঙ্গামাটিতে ১টি এবং চুয়াডাঙ্গায় ১টি ভূমিকম্প হয়েছে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প ছিল শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলায়। ২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর ঢাকার ৪৮ কিলোমিটার দূরে এ ভূমিকম্পের মাত্রা রিখটার স্কেলে ৪.১ ছিল।
ইতিহাস বলছে, ১৮৯৭ সালের ‘মহা আসাম’ ভূমিকম্প ভারতীয় উপমহাদেশকে কেঁপে তুলেছিল, যা ঢাকার কিছু অংশেও পৌঁছেছিল। এই ঘটনার এক শতাব্দীরও বেশি সময় কেটে গেছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এই অঞ্চলে আরও একটি বড় ভূমিকম্প ঘটতে পারে—যা ঢাকার ২ কোটি ২০ লক্ষ বাসিন্দার জন্য বিধ্বংসী পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর হিসেবে, ঢাকা দুর্যোগ মোকাবিলায় উদ্বেগজনকভাবে অপ্রস্তুত। যদিও দেশে বছরের পর বছর ছোটখাটো ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে, তবুও শহরের সমন্বিত প্রতিক্রিয়া কেবল ক্ষণস্থায়ী উদ্বেগের বিষয়। এখন আর ভূমিকম্প কখন হবে সেটি নয়, বরং কোথায় হবে সেটিই জনসাধারণের মূল প্রশ্ন।
ঘন নগরায়ন এবং দুর্বলভাবে প্রয়োগ করা বিল্ডিং কোডের কারণে ঢাকা বড় ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ভয়াবহ ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে।
ভূতাত্ত্বিক অবস্থান, মানবিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির কারণে ঢাকা ভূমিকম্পের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ভূমিকম্প দুর্যোগ ঝুঁকি সূচক অনুসারে, রাজধানী বিশ্বের ২০টি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহরের শীর্ষে রয়েছে।
যদিও বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়—বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার ক্ষেত্রে—উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে, ঢাকায় পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। এ জন্য সরকারের অর্থপূর্ণ মনোযোগ প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের উচিত: নিয়মিত ভূমিকম্প মহড়ার মাধ্যমে নাগরিকদের সচেতন করা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শিশুদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া, স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা, উদ্ধার অভিযানের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় প্ল্যাটফর্ম গঠন করা।
দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে, সরকারকে জাতীয় ভবন কোডের যথাযথ বাস্তবায়ন জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে সঠিক বাস্তবায়ন পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করে কোডটি হালনাগাদ করা উচিত।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন