আগুন যতটা উপকারী, ততটাই ভয়ংকর হতে পারে এক মুহূর্তের অসাবধানতায়। আগুনে পোড়ার মতো দুর্ঘটনা মুহূর্তেই একটি স্বাভাবিক জীবনকে পাল্টে দিতে পারে। পোড়া দেহের যন্ত্রণা যেমন অসহনীয়, তেমনি চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের পথও দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল। কিন্তু এই ভয়াবহতা অনেকাংশেই হ্রাস করা সম্ভব যদি আমরা আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর দ্রুত এবং সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি।
তাই আগুনে পুড়ে গেলে কী করণীয়, তা জানা প্রত্যেক মানুষের জন্যই জরুরি-
প্রথমেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিন
আগুনের সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তি যতক্ষণ সেখানে থাকবে, তার শরীরে পোড়ার পরিমাণ ততই বাড়বে। তাই প্রথম কাজ হচ্ছে—অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব আগুনের উৎস থেকে দূরে সরিয়ে একটি খোলা ও নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া। যদি পোশাক আগুন ধরে যায়, তবে মাটিতে গড়াগড়ি করতে বলা উচিত এবং শরীরে বাতাস ঢুকতে না দেওয়ার জন্য কম্বল বা মোটা কাপড় দিয়ে আগুন ঢেকে ফেলা উচিত।
দগ্ধ স্থানে ঠান্ডা পানি দিন, কিন্তু সরাসরি বরফ নয়
পোড়ার স্থান যত দ্রুত ঠান্ডা করা যাবে, ক্ষতির পরিমাণ তত কমবে। এজন্য আক্রান্ত অংশে ১০–২০ মিনিট সাধারণ ঠান্ডা (নলকূপ, কলের) পানি ঢালতে হবে বা পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। তবে কখনই বরফ ব্যবহার করা যাবে না, কারণ বরফ চামড়ার কোষে অতিরিক্ত ক্ষতি করতে পারে এবং রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত করে।
পোড়া স্থানে কিছুই মাখাবেন না (যেমন টুথপেস্ট, তেল, পেস্ট)
আমরা অনেকেই ভুলভাবে পোড়ার স্থানে ঘরোয়া কিছু মাখাই—যেমন টুথপেস্ট, মাখন, মলম বা তেল। এসব জিনিস ক্ষত স্থানে জীবাণুর জন্ম দেয় এবং চিকিৎসা জটিল করে তোলে। ফলে সংক্রমণ ও প্রদাহ বেড়ে যেতে পারে। তাই কোনো প্রকার রাসায়নিক বা অপ্রয়োজনীয় বস্তু মাখানো থেকে বিরত থাকুন।
ফোস্কা ফাটাবেন না, ঢেকে রাখুন জীবাণুমুক্ত কাপড়ে
দ্বিতীয় স্তরের পোড়ায় অনেক সময় ফোস্কা পড়ে। এগুলোতে তরল জমে থাকে, যা প্রাকৃতিকভাবে ক্ষত স্থানকে সুরক্ষা দেয়। যদি ফোস্কা ফাটিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত সুতি কাপড় বা ব্যান্ডেজ দিয়ে পোড়ার স্থান ঢেকে রাখুন। কাপড় যেন খুব টাইট না হয়।
প্রয়োজনে ব্যথানাশক ও টিটেনাস দিন
প্রাথমিক ব্যথা উপশমের জন্য প্যারাসিটামল বা নির্ধারিত ব্যথানাশক দেওয়া যেতে পারে। যদি দগ্ধ ব্যক্তি গত ৫ বছরে টিটেনাসের টিকা না নিয়ে থাকে, তবে অবিলম্বে তা দেওয়া জরুরি, কারণ পোড়া ক্ষতে জীবাণু প্রবেশ করে ইনফেকশন করতে পারে।
শ্বাসনালীর জটিলতা থাকলে জরুরি চিকিৎসা নিন
যদি দুর্ঘটনাস্থলে ধোঁয়া, গ্যাস বা বিস্ফোরণ থেকে শ্বাসনালীতে পোড়ার সম্ভাবনা থাকে (যেমন মুখ, নাক, গলা বা বুকের আশপাশে দগ্ধ হয়েছে), তাহলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। কারণ এতে শ্বাসকষ্ট, কাশি, বা শ্বাসনালীর অভ্যন্তরে পোড়ার ক্ষতি হতে পারে—যা প্রাণঘাতী।
বড় পরিমাণ পোড়া হলে অবিলম্বে হাসপাতালে যান
যদি শরীরের একটি বড় অংশ পুড়ে যায়, অথবা যদি পোড়া হয় মুখমণ্ডল, হাত, পা, যৌনাঙ্গ বা জয়েন্টের স্থানে—তাহলে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব বার্ন ইউনিট বা বিশেষায়িত হাসপাতালে নিতে হবে। বড় দগ্ধতায় দ্রুত পানি ও লবণের ঘাটতি হয় এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসা ছাড়া এটি বিপজ্জনক হতে পারে।
পোড়ার পর সঠিক খাদ্য ও পুনর্বাসনের যত্ন নিন
দগ্ধ ব্যক্তির শরীরে পুষ্টির চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। তাই তাকে উচ্চ ক্যালরি, প্রোটিন ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে। পানিশূন্যতা রোধে প্রচুর পানি ও তরল খাবার দেওয়া উচিত। দগ্ধ স্থানে নিয়মিত ড্রেসিং করতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী।
দগ্ধ ব্যক্তির মানসিক পুনর্বাসনও জরুরি
অনেক সময় পোড়ার ক্ষত শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। রোগী আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, হতাশ হয়ে পড়ে। তাই পরিবারের ভালোবাসা, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এবং প্রয়োজনে মনোবিজ্ঞানীর সহায়তা অপরিহার্য।
আগুনে পোড়া দুর্ঘটনা কারো জীবনে যেন অভিশাপ হয়ে না আসে, সে জন্য সচেতনতা ও প্রস্তুতি সবচেয়ে বড় অস্ত্র। শুধু দুর্ঘটনা প্রতিরোধই নয়, দুর্ঘটনার পর সঠিক পদক্ষেপ ও দ্রুত চিকিৎসা একটি জীবনকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে।
তাই আমরা সবাই যেন আগুনে পুড়ে গেলে করণীয় বিষয়গুলো জানি, প্রয়োগ করি এবং অন্যদেরকেও সচেতন করি।
আপনার মতামত লিখুন :