ঢাকা সোমবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫
শীতের খোঁজে

হিমালয়কন্যা পঞ্চগড়ে

মো. মাসুদ হোসেন

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৭, ২০২৪, ০৪:৪৭ পিএম

হিমালয়কন্যা পঞ্চগড়ে

ছবি: ইন্টারনেট

একদিন বিকেলে সহকর্মী বড় ভাইদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আড্ডাকালীন কমবেশি সবাই ফেসবুক ব্রাউজিং করছিলাম। এরমধ্যে ফেসবুক স্ক্রলিংয়ের একপর্যায়ে সহকর্মী সাইফুল ইসলাম সিফাত ভাইয়ের ফেসবুক টাইমলাইনে চলে আসে কাঞ্চনজঙ্ঘার কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন ছবি। আর ফেসবুকের এমন ছবি দেখে মুহূর্তেই মন জুড়িয়ে যায় তার। তাৎক্ষণিক কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রতি দুর্বলতার কথা উপস্থিত সবাইকে জানান তিনি। সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘাটি সরাসরি দেখার প্রস্তাব করে ফেলেন। আমরা ভার্চুয়াল জগত থেকে বেরিয়ে তার প্রস্তাবকে সম্মতি দিই। আমরা যেহেতু ভ্রমণপিপাসু, সেই সুবাদে উত্থাপিত প্রস্তাবটি একটু ব্যতিক্রম। কারণ এই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে হলে চলে যেতে হবে বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে।


‘উত্তরের প্রবেশদ্বার, সবুজ চায়ের সমাহার’ ব্র্যান্ডিংয়ের এই পঞ্চগড়ে যেতে হলে আমাদের পাড়ি দিতে হবে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার পথ। যেই ভাবা সেই কাজ। সবার সম্মতিক্রমে সবকিছু বিবেচনা করে মাঝখানে দুদিনের ব্যবধানে অনলাইনে অগ্রিম ৫টি ট্রেনের টিকিট করে ফেলি। ট্রেনের টিকিট বুকিং দেওয়ার পর সবার মনে বইতে থাকে আনন্দের হাওয়া। এরমধ্যে আমরাও সবার অবস্থান থেকে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দেই। ভ্রমণ যাত্রার সেই কাক্সিক্ষত দিনে সহকর্মী শিমুল হাসান ও ইকবাল হোসেন ফরিদগঞ্জ থেকে, সাইফুল ইসলাম সিফাত ও মেহেদী হাসান রিমেল হাজীগঞ্জ আর আমি চাঁদপুর সদর থেকে রওনা দিয়ে চাঁদপুর লঞ্চঘাটে এসে পৌঁছাই দুপুর সোয়া ১টায়। তারপর ২৫০ টাকায় জনপ্রতি টিকিট কেটে দুপুর ২টায় লঞ্চঘাট থেকে ঢাকার সদরঘাটের উদ্দেশ্যে চাঁদপুর ত্যাগ করি। নৌভ্রমণের এই সময়টিতে রয়েছে ফটোসেশনসহ ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা। চার ঘণ্টার টানা জার্নি শেষ করে সন্ধ্যা ৬টায় রাজধানী ঢাকার সদরঘাটে লঞ্চ ভিড়লে দ্রুত নেমে একটি ইজিবাইক ভাড়া নিয়ে চলে যাই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। যেহেতু আমরা ৫ জন; ঢাকার রাস্তায় একটি সিএনজিতে ৫ জন ওঠা সম্ভব নয় বলে ব্যাটারিচালিত একটি ইজিবাইক নিয়েছি। সদরঘাটে যতগুলো ইজিবাইক চালকের সঙ্গে ভাড়ার ব্যাপারে কথা বলেছি, সবার একই কথা ৩৫০ টাকা ছাড়া কমলাপুর যাবে না। একটু সামনে এগোতেই ২৭০ টাকায় পেয়ে গেলাম। যেতে যেতে ইজিবাইক চালকের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কথা হয় আমাদের। গত কয়েক বছর আগে তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় তার একটি পা হারিয়ে ফেলেন। গাজীপুর আশুলিয়ায় তার বাড়ি। থাকেন ঢাকার মুগদায়। একটি কৃত্রিম পা লাগিয়ে ইজিবাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তখনই বুঝেছি, যারা সুস্থ ও সবল; তারা ৩৫০ টাকার কমে যাবেন না। অথচ একজন অসচ্ছল ব্যক্তি ঠিকই কমে আমাদের নিয়ে এলো কমলাপুর রেলস্টেশনে। এদিকে মাইকে ঘোষণা দিচ্ছে ট্রেন ছাড়ার বিস্তারিত জানিয়ে। সময় তখন গড়িয়ে রাত পৌনে ৮টা। সেখানের একটি রেস্টুরেন্টে নাস্তা করে দ্রুত চলে যাই স্টেশনের ৭ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। প্ল্যাটফর্মে পৌঁছাতেই কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসে পঞ্চগড়গামী ট্রেন ‘দ্রুতযান এক্সপ্রেস’। এরমধ্যে একটি গ্রুপ ছবিও তুলে ফেললাম আমরা। টিকিট বুকিং দেওয়া নির্ধারিত বগিতে উঠে নির্দিষ্ট আসনে বসে পড়ি সবাই। রেলওয়ের নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আধাঘণ্টা বিলম্বে ট্রেন ছাড়লেও পঞ্চগড় বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছায় পরদিন সকাল ৯টায়। আমাদের এই প্রথম লম্বা জার্নিতে হয়েছে অনেক ব্যতিক্রমী ঘটনা। প্রথমে ট্রেনটি দ্রুতযান হলেও ঘন ঘন স্টেশনে স্টপিজ। তার ওপর সিরাজগঞ্জ রেলস্টেশন পার হওয়ার পর ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে দুটি মোবাইল ফোন হারিয়েছে দুজন ট্রেন যাত্রী। সেই সঙ্গে একই স্থানে প্রায় আধাঘণ্টার মতো দাঁড়ানো ট্রেন। এ রকম বহু ঘটনা রয়েছে এই ট্রেন যাত্রায়। যাই হোক, সকালে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের ওয়াশরুমে গিয়ে সবাই ফ্রেশ হয়ে রওনা দিই অচেনা একটি শহরের উদ্দেশ্যে। প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়েই বাহিরে দেখা মিলে অনেক ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ভ্যানগাড়ির। সারা দিনের জন্য ১৫০০ টাকায় ভাড়া চুক্তি করে চললাম। 


হিমালয়কন্যা পঞ্চগড়ের বাজারে গিয়ে একটি হোটেলে সবাই নাস্তা খেয়ে চলে যাই মিরগড় বাজারে। সেখানে পঞ্চগড়ের বিখ্যাত খাবার টোপার স্বাদ নিয়ে চলে গেলাম করতোয়া নদীর ওপর কাঠের ব্রিজে। সেখানে করতোয়া নদী থেকে স্থানীয়দের পাথর আর বালি উত্তোলন করা দেখা ছিল আমাদের অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। সেখানের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করে চলে যাই বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পঞ্চগড়ের আটোয়ারি উপজেলার মির্জাপুর শাহী মসজিদ দেখতে। ১৯৫৬ সালে নির্মিত ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২৫ ফুট প্রস্থের এ মসজিদটির সামনের দেওয়ালে চিত্রাঙ্কন ও বিভিন্ন কারুকার্য রয়েছে যেগুলো একটি অপরটি থেকে আলাদা। একই সারিতে মসজিদটিতে রয়েছে তিনটি গম্বুজ। প্রতিটি গম্বুজের কোণায় একটি করে মিনার আর ফারসি ভাষার একটি শিলালিপি রয়েছে যেটা থেকেই ধারণা করা হয় এটি মুঘল আমলে নির্মিত হয়েছিল। এখানেও সবাই সবার স্মৃতি ধারণ করে রওনা দিলাম আমাদের কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য তেঁতুলিয়ার দিকে।


তেঁতুলিয়া যেতে যেতে সবার চোখেই ভিড় জমায় ঘুম আর ঘুম। কারণ সারারাত নির্ঘুম কেটেছে সবার। মূলত ট্রেন জার্নিতে ঘুম না আসারই কথা। জেলা শহর থেকে তেঁতুলিয়া যাওয়ার পথে সদর উপজেলার অমরখানা এলাকায় পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়কের পাশে চাওয়াই নদের ধারে রয়েছে মুক্তাঞ্চল পার্ক। সেখানে কিছুক্ষণ যাত্রা বিরতি দিয়ে সবাই চা পান করি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধমুক্ত থাকা এই মুক্তাঞ্চল পার্কে রয়েছে পঞ্চগড়ের পাঁচটি গড়ের ইতিহাস। খোলামেলা এই পার্কের ভেতরে কিছু ছবি তুলে আবারও রওনা দিই তেঁতুলিয়ার দিকে। কিছুক্ষণ চলার পর আবারও যাত্রা বিরতি দিই ভারত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি সমতল ভূমির চা বাগানে। সেখানে ফটোসেশন করে রওনা দিয়ে চলে যাই তেঁতুলিয়া বাজারে। অটোচালক আমাদের নিয়ে নামিয়ে দেন সুবিশাল আকৃতির সেই বিখ্যাত তেঁতুল গাছের নিচে। পরে স্থানীয় এক শুভাকাক্সিক্ষর সহযোগিতায় রাত্রীযাপনের জন্য একটি আবাসিক হোটেলে উঠি। ওখানে ফ্রেশ হয়ে তেঁতুলিয়া ইউএনও ফজলে রাব্বির আমন্ত্রণে রাত ৯টায় তার অফিসে ও বাংলোতে যাই। যথেষ্ট আপ্যায়ন আর খোশগল্প শেষে বিদায় নিয়ে তেঁতুলিয়া বাজারে এসে রাতের খাবার খেয়ে পুরাণ বাজার মহানন্দা নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে পুনরায় হোটেলে ফিরে আসি।


পরদিন ভোর সাড়ে ৬টায় ঘুম থেকে উঠে চলে যাই আমাদের পূর্বনির্ধারিত গন্তব্য ডাক বাংলোতে। ওখানে পৌঁছে দেখি শত শত পর্যটকের সমাগম। আমাদের আর তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য। সময় গড়িয়ে গেলেও আমাদের চোখে দেখা দেয়নি স্বার্থপর সেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। ভারতের সিকিম রাজ্য ও নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী হিমালয় পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘা না দেখেই চলে আসতে হলো আমাদের হোটেলে। সেখানে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে চলে যাই তেঁতুলিয়া বাজারে। ওখানে সকালের নাস্তা খেয়ে পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। পঞ্চগড় বাসস্ট্যান্ড থেকে অটোযোগে রেলস্টেশনে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ঢাকাগামী আন্তঃনগর পঞ্চগড় এক্সপ্রেস যাত্রা শুরু করে। ট্রেনটির সার্ভিস ভালো হলেও ঢাকায় একটি আন্দোলনের কারণে সিরাজগঞ্জ থেকে বিভিন্ন জায়গায় বিরতি দিয়ে ২ ঘণ্টা পর কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছায়। সেখান থেকে সদরঘাট গিয়ে আবার লঞ্চযোগে নিজ জেলা ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর আসি।


দর্শনীয় স্থান : কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার পাশাপাশি এই জেলাটিতে রয়েছে প্রায় ৪ হাজার একর সমতল ভূমির সবুজ চা বাগান। যা পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। এ ছাড়াও বাণিজ্যের সম্ভাবনাময় স্থলবন্দর বাংলাবান্ধার জিরো পয়েন্ট। তেঁতুলিয়া উপজেলা শহরে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জেলা পরিষদ ডাকবাংলো। এই ডাকবাংলোর পাশ দিয়েই বয়ে গেছে বাংলাদেশ ও ভারতকে বিভক্ত করা মহানন্দা নদী। এই নদীতে শ্রমিকেরা নুড়িপাথর তোলেন। বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নে আছে বোদেশ্বরী মন্দির। এ ছাড়া দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নে আছে প্রাচীন মন্দির গোলকধাম। সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নে ভারত সীমান্তঘেঁষা ভিতরগড় এলাকায় আছে দেড় হাজার বছরের পুরোনো সুবিশাল মহারাজার দীঘি। আছে ভিতরগড় দুর্গনগরী। পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থিত দেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর ‘রকস মিউজিয়াম’। রয়েছে কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেটসহ বহু দৃষ্টিনন্দন পর্যটনকেন্দ্র। 

 

কীভাবে যাওয়া যায় : ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে পঞ্চগড়গামী সকাল সোয়া ১০টায় একতা এক্সপ্রেস, রাত ৮টায় দ্রুতযান এক্সপ্রেস ও রাত সাড়ে ১১টায় পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেন ছেড়ে যায়। এসব ট্রেনেই শোভন চেয়ারের ভাড়া ৬৯৫ টাকা, স্নিগ্ধা ১৩৩৪ টাকা ও এসি বাসে ২৩৯৮ টাকা ভাড়া নিয়ে থাকে। এ ছাড়াও সড়ক পথে ঢাকার শ্যামলী ও গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন মানের বাস ছেড়ে যায়। মান অনুযায়ী এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে ভাড়া নিয়ে থাকে।


কোথায় থাকবেন: স্বল্প খরচে পঞ্চগড় জেলা সদরে কয়েকটি আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি তেঁতুলিয়ায় রয়েছে হোটেল হিমালয়, হোটেল সীমান্তের পাড় ও হোটেল নিরব নামে রাত্রিযাপনের অসংখ্য ঠিকানা।  


যে বিষয় খেয়াল রাখবেন: স্থানীয়দের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে চলার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা একান্ত কর্তব্য।

আরবি/ এম এইচ এম

Link copied!