ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট, ২০২৫

জবানবন্দিতে শহীদ তাইমের ভাই

‘গুলি খেয়ে বাঁচার আকুতি, উপভোগ করছিল পুলিশ’

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২৫, ১১:০৯ পিএম
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ছবি- সংগৃহীত

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদ ইমাম হাসান তাইমের ভাই রবিউল আউয়াল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ নিজের ভাইকে হত্যার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন।

রবিউল বলেন, “দৌড় দিতে বলে প্রথমে পায়ে গুলি করা হয়। পেছনে ফিরে তাকালে আবার গুলি। তারপর আরও গুলি। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ভাই রক্তাক্ত শরীরে বাঁচার আকুতি জানালেও কোনো উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার বুক কাঁপেনি; বরং তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর ‘উপভোগ’ করেছেন। এমনকি বুট জুতা দিয়ে মারধর করে ভাইয়ের চেহারা বিকৃত করা হয়।”

সোমবার (১৮ আগস্ট) ট্রাইব্যুনালে এই জবানবন্দি রেকর্ড করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল। রবিউল ছিলেন ১১ নম্বর সাক্ষী। সাক্ষ্যগ্রহণের এই দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আরও তিন জনের বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষ্য ধার্য ছিল।

রবিউল জানান, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি নিজে সিলেটে অংশগ্রহণ করেন, আর তার ছোট ভাই তাইম যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় আন্দোলনে ছিলেন। ১৬ থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত তাইম সারা দিন আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। যদিও আন্দোলনে যাওয়ায় বাধা দিতে তার মা পাশে বসে থাকতেন, তার ব্যাগ নিয়েও। ১৯ জুলাই রাতে কারফিউ জারি করা হয়। ২০ জুলাই দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকায় তাইম বাইরে গিয়ে আন্দোলনে যোগ দেন।

রবিউল বলেন, আন্দোলনের সময় দুইবার তাইমকে কল করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ফোন রিসিভ হয়নি। ২০ জুলাই দুপুরে মা ও রবিউল একই সময়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার সংবাদ পান। বাড়িওয়ালার মাধ্যমে খবরটি মায়ের কাছে পৌঁছায়। ঘটনাস্থল কাজলা ফুটওভার ব্রিজের পাশে গিয়ে তাইমের মা ভাইয়ের জুতা ও রক্ত দেখতে পান। উপস্থিত লোকজন জানান, পুলিশ তাকে ভ্যানে তুলে যাত্রাবাড়ী থানায় নিয়ে গেছে। এরপর ঢামেক হাসপাতালে খোঁজার চেষ্টা করেও মৃত অবস্থায় তার সন্ধান পান।

রবিউল বর্ণনা দেন, পুলিশ টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি ছুড়লে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তাইম দুই বন্ধু নিয়ে লিটনের চায়ের দোকানে আশ্রয় নেন, কিন্তু পুলিশ তাদের খুঁজে বের করে বেধড়ক পেটাতে থাকে। এরপর ‘দৌড়াতে বলার’ সময় প্রথম গুলি চালানো হয় তার পায়ে। পেছনে তাকালে দ্বিতীয় গুলি লাগে। এরপর ধারাবাহিকভাবে পুলিশ তার শরীরে গুলি চালাতে থাকে।

রবিউল বলেন, তার বন্ধু রাহাত বাঁচানোর চেষ্টা করলেও পুলিশ তাকে বাধ্য করে চলে যেতে। তাইম আধা ঘণ্টা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলেন। সাংবাদিকসহ উপস্থিতরা তাকে হাসপাতালে নিতে চাইলেও পুলিশ অনুমতি দেয়নি। বরং মৃত্যুর এই দৃশ্য পুলিশ ‘উপভোগ’ করছিল। পরে ভ্যানে তুলে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে নিয়ে গিয়ে বুট দিয়ে মারধর করা হয়, যার ফলে তার চেহারা বিকৃত হয়। এরপর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

রবিউল আরও জানান, হত্যাযজ্ঞের সময় উপস্থিত ছিলেন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, যুগ্ম কমিশনার প্রলয়, ডিসি ইকবাল, এডিসি মাসুদুর রহমান মনির, এসি নাহিদ, এসি তানজিল, ওসি আবুল হাসান, ওসি (অপারেশন) ওয়াহিদুল হক মামুনসহ ১০-১৫ জন কর্মকর্তা।

সাক্ষীর দাবি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের নির্দেশে আন্দোলনকারী প্রায় দুই হাজার ছাত্র-জনতা নিহত হয়েছেন। রবিউল তাইমের হত্যার জন্য অভিযুক্তদের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন।

আজকের সাক্ষ্যগ্রহণে রবিউল ছাড়াও শহীদ আস-সাবুরের বাবা মো. এনাব নাজেজ জাকি এবং রাজশাহীর প্রত্যক্ষদর্শী জসিম উদ্দিন সাক্ষ্য দেন। মামলায় এখন পর্যন্ত ১২ জন সাক্ষী জবানবন্দি দিয়েছেন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণ ২০ আগস্ট অনুষ্ঠিত হবে।