ঢাকা সোমবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৫

মতামত

নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ

সিরাজুল ইসলাম, সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২৫, ১০:০৬ পিএম
সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিরাজুল ইসলাম। ছবি- সংগৃহীত

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য একটি সময় ঘোষণা করা হয়েছে। গত ৫ই আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণের সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই সম্ভাব্য সময়ের কথা জানান। তিনি সেদিন বলেছেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রমজান শুরুর আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যদিও তিনি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করেননি, তারপরেও সম্ভাব্য এই সময় ঘোষণা করার কারণে দেশের বিরাট জনসংখ্যার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ উচ্ছ্বাস বয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের বিষয়ে এই ঘোষণায় বলা যায় বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কেটে যেতে শুরু করেছে। 

গত একটি বছরের টালমাটাল রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে যে অস্থিরতা বিরাজ করছিল, যে ধরনের সম্ভাব্য সংকট আসতে পারতো তার অনেক কিছুই এখন মুছে গেল বা বন্ধ হয়ে গেল বলে মনে করা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা গত বৃহস্পতিবার (৭ জুলাই) সচিবালয়ের মন্ত্রী পরিষদ কক্ষে উপদেষ্টাদের বৈঠকে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম ধাপ শেষ করে দ্বিতীয় ধাপে পা রেখেছে। এখন দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানই মূল কাজ। 

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংখ্যা বাড়ানো হবে বলে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আছে ৮ লাখ, সেটা আরো ৫০ হাজার বাড়ানো হবে। নির্বাচনে ৬০ হাজার সেনাবাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করে, এ সংখ্যাও বাড়ানো হবে।

প্রেস সচিব আরও জানান, বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো। অন্তর্বর্তী সরকারের দেশ পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনী এখনো মাঠে মোতায়েন রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মাঠ প্রশাসন যাদের সঠিকভাবে কাজ করে সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রেস সচিব বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা এটাই ছিল যাতে উপদেষ্টারা নিজেদের জায়গা থেকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কাজ করেন। 

এদিকে, ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার পরদিনই প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, দেশ আজ থেকে নির্বাচনের ট্রেনে যাত্রা শুরু করেছে। তার মানে হচ্ছে দেশে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।

অন্যদিকে, বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মোহাম্মদ সানাউল্লাহ বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। এ সংক্রান্ত তাদের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে রয়েছে। 

এ কথা খুবই পরিষ্কার যে, গত বছরের ৫ ই আগস্ট তুমুল গণ আন্দোলনের মুখে হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্ন তৈরি হয়। শেখ হাসিনার আমলে যে তিনটি নির্বাচন হয়েছে তার একটিও গ্রহণযোগ্য হয়নি। সে প্রেক্ষাপটে দেশের তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের অধিকাংশই আজ পর্যন্ত নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। এছাড়া, জাতীয় নির্বাচনগুলো একচেটিয়া নিজেদের মতো করে সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা তার স্বৈরাচারী শাসন-শোষণ অব্যাহত রেখেছিল। তার সরকারের পতনের পর দেশের জনগণের সিংহভাগের ভিতরে নির্বাচনের একটি আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। 

এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন ছাড়া এক বছর পার হওয়াটাই অনেক বেশি। তারপরও শেষ পর্যন্ত যে নির্বাচনের ঘোষণা এসেছে সেটা অবশ্যই সাধুবাদ পাবার যোগ্য। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি-সহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল সাধুবাদ জানিয়েছেও। নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা ঘোষণা করার পর নির্বাচনের জন্য উন্মুখ লোকজন নির্বাচনী উচ্ছ্বাস ফিরে পেয়েছে। তবে চলমান বাস্তবতায় বেশ কিছু ঝুঁকি ও সংকট রয়েছে। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এই বাস্তব ঝুঁকি ও সংকটকে মাথায় নিয়ে সামনে এগোতে হবে। 

নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নানা ধরনের ঘোষণার পর বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ ইমরান সালেহ প্রিন্স বলেছেন, জনগণের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটছে, নির্বাচনে দামামা বাজতে শুরু করেছে। নির্বাচনী ট্রেন চলতে শুরু করেছে। আগামী রমজানের আগেই নির্ধারিত স্টেশনে এই ট্রেন পৌঁছাবে। এবারের নির্বাচনে ধানের বাম্পার ফলন হবে। 

এদিকে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং প্রভাবশালী নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, জনগণ একটি নিরাপদ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন চায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশের কাঠামো রাতারাতি বদলানো সম্ভব নয়। তাই নির্বাচনকালীন নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে থাকা উচিত। 

গত বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) রাজধানীর গুলশানে নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে একথা বলেন বিএনপির এই শীর্ষ নেতা। 

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য থাকলেও জাতীয় ইস্যুতে এক টেবিলে বসার পরিবেশ তৈরি করতে কাজ করছে বিএনপি। বাংলাদেশপন্থী ও মধ্যপন্থী দল হিসেবে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে সব মত-পথের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানান তিনি।
 
অন্যদিকে, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনে চিঠি পাঠায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এ প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতি এই ধরনের উদ্যোগেরই অপেক্ষায় ছিল। এখন দ্রুত নির্বাচন সংশ্লিষ্ট আইন প্রণয়ন করা জরুরী। 

নির্বাচনকালে নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে থাকা উচিত বলেও মন্তব্য করেন বিএনপির এই নেতা। তিনি সুস্পষ্ট করে বলেন, জনগণ একটি নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ নির্বাচন চায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশের কাঠামো রাতারাতি বদলানো সম্ভব নয়। তাই নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা রক্ষার মূল দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে থাকা উচিত।

নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ইতিহাস

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন থেকেই নির্বাচনকে ঘিরে সেনাবাহিনী মোতায়েনের রেওয়াজ চলে আসছে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচন থেকে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েনের চল শুরু হয়েছে, বিবিসিকে এমনটাই জানিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন। 

তিনি বলেন, “১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বেশি সংখ্যক পুলিশ ছিল না। অন্যান্য বাহিনীতেও যথেষ্ট পরিমাণ সদস্য ছিল না। তাই জনবল বাড়ানোর জন্য সেসময় সেনাবাহিনীকে ডাকা হয়েছিল।”

জেনারেল সাখাওয়াত বলেন, “এরপর ১৯৯১ সালের আগ পর্যন্ত সব নির্বাচনই হয়েছে সেনা সমর্থিত প্রশাসনের অধীনে। স্বাভাবিকভাবেই সেসব নির্বাচনে সেনা উপস্থিতি ছিল।”

আগের নির্বাচনগুলোর ওই ধারাই ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অনুসরণ করা হয় এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনসহ সে বছরের ১২ই জুন ও ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর হওয়া নির্বাচনেও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিতই হয় সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ২০১৪ সালে পরের নির্বাচনে মোট ১৫ দিনের জন্য নিয়োজিত হয়েছিল সেনাবাহিনী। সবশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় ৩৮৮টি উপজেলায় ৩৫ হাজারেরও বেশি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়।

কেন সেনাবাহিনী প্রয়োজন?

জনবহুল আমাদের এই দেশে সুষ্ঠু সুন্দর রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে না ওঠার কারণে নির্বাচনে অসুস্থ প্রতিযোগিতা হয়। প্রতিদ্ব প্রার্থীদের মধ্যে অনেক সময় পেশীশক্তির ব্যবহার হয়, ভোটকেন্দ্র দখল হয়, ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা হয়, পেশীশক্তির ব্যবহার করে ইচ্ছামতো প্রার্থীদের পক্ষে ভোট নেয়ার ঘটনা অহরহ ঘটে। পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করার ক্ষেত্রে যেমন ব্যবহার হয় অর্থ, তেমনি ব্যবহৃত হয় লাঠিয়াল বাহিনী। নির্বাচনী আচরণবিধি থেকে শুরু করে নানা রকমের আইন-কানুন থাকলেও সেগুলো সুচারুভাবে প্রতিপালন করার সংস্কৃতি আমাদের দেশে খুব একটা নেই। এর বিপরীতে যেকোন উপায়ে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার প্রবণতা অনেক প্রার্থীর ভেতরে থাকে। এসব কারণে নির্বাচনের আগে থেকেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরের কয়েকদিন পর্যন্ত সংঘাত সংঘর্ষ এমন কি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। এই সমস্ত সংকট মোকাবেলায় মাঠে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি অপরিহার্য।

 সেনাবাহিনী হচ্ছে এই দেশের সাধারণ মানুষের অনেকের কাছেই আশা ভরসার আশ্রয়স্থল। যেকোনো অন্যায় অনিয়ম যখন লাগামহীনভাবে চলতে থাকে তখন সাধারণ মানুষের ভেতরে একথাই জেগে ওঠে, সেনাবাহিনী নামলে বা সেনাবাহিনী এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করলে সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে। এদেশের মানুষ সংবিধান বা আইনের অত মারপ্যাচ বুঝতে চায় না, তারা চায় যেকোন সমস্যার দ্রুত ও সুষ্ঠু সমাধান। আর নির্বাচনের ময়দানে যখন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং পেশীশক্তি ও অর্থের ব্যবহারের আশঙ্কা তখন সেখানে সেনাবাহিনীর অবস্থান অপরিহার্য মনে করে এই দেশের সাধারণ ভোটাররা। তাদের মধ্যে এই ধারণা বিদ্যমান যে, নির্বাচনের মাঠে সেনাবাহিনী থাকলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। অতি বাস্তব কথা হলো- এই ধারণা এমনি এমনি গড়ে ওঠেনি, বেশ কিছু নির্বাচন আছে এবং অনেক ঘটনা আছে যেখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কারণে অনেক অন্যায় অনিয়ম প্রতিরোধ করা গেছে। তবে অবশ্যই এর জন্য সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে, নির্বাচনের মাঠে সেনা মোতায়েন করলে সেনাবাহিনীর হাতে সেইভাবে ক্ষমতা দিতে হবে। নির্বাচন সুষ্ঠ ও অবাধ করার জন্য তাদের হাতে যদি প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেয়া হয় তাহলে নির্বাচনের মাঠে পেশী শক্তির ব্যবহারকারীদের দৌরাত্ম্য কমতে বাধ্য।

অতীতের বহু নির্বাচনেই দেখা গেছে, যেখানে গোলমাল হয়েছে, প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে সেখানেই কথা উঠেছে যদি সেনাবাহিনী থাকত তাহলে এগুলো ঘটতে পারত না। একেবারেই এটি মানুষের ভরসার কথা, আস্থার কথা। তবে হ্যাঁ এর ব্যতিক্রম কিছু কিছু ঘটনাও আছে। শেখ হাসিনার আমলে যেসব নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে সেখানে প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনীকে কার্যকর ফোর্স হিসেবে মোতায়েন করা হয়নি বরং জনগণের আইওয়াশ করার জন্য তাদেরকে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো আমাদের সামরিক বাহিনীর জন্য লজ্জার বিষয়। 

যাইহোক, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। প্রধান উপদেষ্টা সেনাবাহিনী মোতায়েনের যে কথা বলেছেন তাতে পরিষ্কার যে, আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। এতে জনগণের মনে সেই আশা দানা বাঁধছে- যে আশা বার বার তারা করেছে। এই বাস্তবতা সামনে রেখে সেনাবাহিনীকেও কাজ করতে হবে। সত্যিই এই দেশে সুষ্ঠু-সুন্দর একটা নির্বাচন বড় বেশি দরকার। এজন্য, সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ জায়গা থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে।