জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় সারা দেশের মতো মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায়ও ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলন। তবে আন্দোলন চলাকালে ওই উপজেলায় পুলিশ কিংবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছাত্র-জনতার বড় ধরনের কোনো হামলা কিংবা সংঘাত হয়নি। তবে দুই দিন পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়েছে। এতে দুই-তিনজন সামান্য আহত হয়েছেন। অথচ আহত হিসেবে সুচিকিৎসার জন্য কুলাউড়ার ২৮ ছাত্র-জনতা পেয়েছেন ২৮ লাখ টাকা সরকারি অনুদান। অনুদানের এই তালিকা দেখে হতবাক উপজেলাটিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাসহ সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, অনুদান পাওয়া ২৮ জনের মধ্যে আহত হওয়া দূরের কথা দুই-একজন ছাড়া কেউই আন্দোলনেই ছিলেন না। তারপরও কীভাবে তারা অনুদান পেলেন তা নিয়ে চলছে সমালোচনার ঝড়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মৌলভীবাজার জেলা শাখার অন্যতম সমন্বয়ক ওসমান গণিও স্বীকার করেন, আমার জানামতে, কুলাউড়ায় তেমন কোনো বড় ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেনি।
একইভাবে আহত না হয়েও আহত হিসেবে সুনামগঞ্জে জুলাই গণঅভ্যুত্থান যোদ্ধার চেক পেয়েছেন আল হেলাল নামের এক আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সহ-সভাপতি। এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সুনামগঞ্জ জেলার সদস্য সচিব মেহেদী হাসান সাকিব বলেন, আল হেলাল নামের মানুষ সুনামগঞ্জের কোথাও আন্দোলনে অংশ নেয়নি। তিনি আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের সহ-সভাপতি। আমাদের কমিটি হওয়ার আগেই প্রশাসন কিছু মানুষের তালিকাভুক্ত করে নেয়। সেই সুযোগে হয়তো তালিকায় নাম ঢুকেছে।
কুলাউড়া ও সুনামগঞ্জের মতো জুলাই যোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে নরসিংদী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইভা আলমের মেয়ে রাইসা আলমকে। ভুয়া জুলাই যোদ্ধা তালিকাভুক্তির প্রতিবাদ করায় মিনহাজুর রহমান শ্রাবণ (১৭) নামের স্থানীয় এক কলেজশিক্ষার্থীকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করার অভিযোগ উঠেছে ইভা আলমের স্বামী এবং স্থানীয় ইউপি সচিব শাহ আলম ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে।
শুধু কুলাউড়া, সুনামগঞ্জ কিংবা নরসিংদী নয়, সারা দেশেই বেড়েছে ভুয়া জুলাই যোদ্ধাদের দৌরাত্ম্য। জুলাই গণআন্দোলনে আহত হওয়া দূরে থাক অংশগ্রহণ না করেই অনেকে নানা কৌশলে জুলাই যোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন সরকারি সুযোগ-সুবিধা। হাতিয়ে নিচ্ছেন সরকারের কোটি কোটি টাকা। কোনো কোনো জায়গায় এসব ভুয়া জুলাই যোদ্ধারা চাঁদাবাজি ও দখলবাজিতে জড়িয়ে পড়ছেন। এ নিয়ে বিব্রত মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রকৃত জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক সময় ছিল ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উৎপাত। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও জাল-জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদপ্রাপ্ত হয়েছেন। এই সনদ নিয়ে তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি নানা অনিয়মেও জড়িয়ে পড়েছে। একই কায়দায় ভুয়া জুলাই যোদ্ধার সনদকে পুঁজি করে চলছে একই কাণ্ড। তারা বলছেন, ঠিকমতো যাচাই-বাছাই করলে তালিকা থেকে অনেক ভুয়া জুলাই যোদ্ধা বের হবে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, রাজধানীর উত্তরা এলাকায় ব্যক্তিগত ঝামেলায় আহত হয়ে গত ৭ আগস্ট জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) চিকিৎসা নিতে আসেন মো. ইলিয়াছ হোসেন হিরন। হাসপাতালে ভর্তির পর সে জানতে পারে যারা জুলাই আন্দোলনে আহত হয়েছেন কিংবা নিহত হয়েছেন তাদের সরকারিভাবে বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া হবে। এতে লোভে পড়ে যায় হিরন। জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে এমন ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট তৈরি করে সে। এরপর জুলাই যোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয়ভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাত থেকে ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে দুই লাখ টাকার চেক গ্রহণ করেন। এ ছাড়া তিনি ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে এক লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা নেন। পরে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে গত ১৫ এপ্রিল জুলাই শহীদ স্মৃতিফাউন্ডেশনে ইলিয়াছ স্বীকারোক্তি দেন তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত হননি। তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত হিসেবে সরকারি তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়াও ঘটেছে একই ধরনের ঘটনা। উপজেলাটিতে বাদল বেপারি ও শাওন বেপারি নামের পিতা-পুত্র পেয়েছে অনুদানের চেক। স্থানীয়রা বলছেন, তাদের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে তা যাচাই করতে তদন্ত কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন। এভাবেই প্রায় প্রতিটি জেলা-উপজেলায়ই অনেক ভুয়া আহতরা জুলাই যোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
এভাবেই ভুয়া জুলাই যোদ্ধারা লুটপাট করলেও অনেক প্রকৃত আহতরা পাচ্ছেন না চিকিৎসা। নিহতদের পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সম্প্রতি চিকিৎসার অভাবে মাথায় গুলি নিয়েই মারা যান পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার আশিকুর রহমান হৃদয়। তিনি গত বছরের ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ী এলাকায় জুলাই আন্দোলনে মাথায় তিনটি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। এর মধ্যে দুটি গুলি অপসারণ করলেও টাকার অভাবে একটি গুলি অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। হৃদয় চিকিৎসার অভাবে মারা গেলেও তার মতো অনেক আহতরা উন্নত চিকিৎসার জন্য রাস্তায় দাঁড়াচ্ছেন। রাজধানীর শাহবাগে প্রায়ই আন্দোলনে নামেন তারা।
সর্বশেষ গত শনিবারও রাজধানীর শাহবাগে রাস্তায় বসে আন্দোলন করেন জুলাই আন্দোলনে আহত কয়েক ব্যক্তি। তারা বলেন, আন্দোলনের পর এতদিনেও তারা পাননি জুলাই যোদ্ধার স্বীকৃতি। অনেকেই পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে। সেখানে কথা হয় জামালপুরের ইসলামপুরের মো. সম্রাট হোসেন সঙ্গে। তিনি আহত হন নারায়ণগঞ্জে। সেখানে তার চোখে গুলি লাগে। প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার চোখের অপারেশন হয়। এরপর অপারেশন হয় জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে এখনো আমার শরীরে ৪০টি গুলি আছে। এ পর্যন্ত আমার পাঁচবার অপারেশন হয়েছে। একটা চোখ বুজে গেছে। আরেক চোখে এখন ঝাপসা দেখি। চোখের বুলেট এখনো বের করতে পারেনি।’
সম্রাটের চারজনের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। তিনি বলেন, দ্রুত আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে। মুখে বলছে, কিন্তু দিচ্ছে না। আর উন্নত চিকিৎসা তো আমরা পেলামই না। যদি উন্নত চিকিৎসা পেতাম, তাহলে হয়তো আমি দুই চোখেই ভালোভাবে দেখতে পেতাম। আমার চোখের নার্ভগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। খুব দ্রুত চিকিৎসার দরকার ছিল। কিন্তু সেই ধরনের চিকিৎসা আমরা পাচ্ছি না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের স্বীকৃতির পাশাপাশি আর্থিক, চিকিৎসাসহ নানা সহযোগিতার উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এজন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠন করা হয় জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর। এই দপ্তর জুলাই যোদ্ধাদের স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট জারির পাশাপাশি আর্থিক সহায়তাসহ আহত ছাত্র-জনতার পুনর্বাসন, প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ঋণ প্রধান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার কথা।
নানা তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে গত জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থানে ৮৩৪ জন শহিদ হয়েছেন উল্লেখ করে গেজেট জারি করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তাদের বলা হয়েছে জুলাই শহিদ। এছাড়াও জুলাই আন্দোলনে অতি গুরুতর আহত ৪৯৩ জনকে ‘ক’ ক্যাটাগরি, গুরুতর আহত ৯০৮ জনকে ‘খ’ ক্যাটাগরি এবং আহত ১০ হাজার ৬৪২ জনকে ‘গ’ ক্যাটাগরির ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকার পরিপ্রেক্ষিতেই এই গেজেট জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর।
সম্প্রতি সারা দেশে ক্যাটাগরিভুক্ত জুলাই যোদ্ধাদের ১ লাখ টাকা করে অনুদান দিচ্ছে সরকার। রংপুর ও চট্টগ্রাম বিভাগ ছাড়া বাকি সব বিভাগের জুলাই যোদ্ধাদের মধ্যে এই অনুদান বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর। রংপুর ও চট্টগ্রামে শিগগিরই অনুদান বিতরণ করা হবে। এই অনুদানের তালিকায় ভুয়াদের নাম দেখেই প্রায় সব জেলায়ই চলছে তোলপাড়।
জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকার কয়েকজন শীর্ষ নেতা বলেন, আন্দোলনের পর সারা দেশে অনেক সমন্বয়ক ও আন্দোলকারীকে দেখা যাচ্ছে না। এসব সুযোগ-সন্ধানীরা এখন সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারী সেজে নানা সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি অনেক অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হচ্ছেন। এর আগে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকেও অনেক ভুয়া ব্যক্তি অনুদান নিয়েছেন। কেউ কেউ ধরাও পড়েছেন। কয়েকজন প্রতারককে জেলহাজতেও পাঠানো হয়েছে। তাদের নিয়ে আমরা বেশ বিব্রত।
কুলাউড়ায় আহত না হয়েও ২৮ ছাত্র-জনতার অনুদান প্রাপ্তির বিষয়ে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জুলাই যোদ্ধা যাচাইয়ের জন্য একটি কমিটি করা হয়েছিল। সেই কমিটির সুপারিশেই তাদের অনুদান দেওয়া হয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আরিফুর রহমান তুহিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এটা পুরোপুরি প্রশাসনের ব্যর্থতা। অনেক জয়গায় জুলাইয়ে প্রকৃত আহতরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। চিকিৎসা করতে পারছে না। জুলাইয়ে শহিদ পরিবার কষ্টে আছে। অথচ জুলাই আন্দোলনে হামলা করতে গিয়ে আহতরা এখন জুলাই যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি নিচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে লাফালাফি করতে গিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন জুলাইকে ভুলে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিষয়টি আমরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। আমাদের কাছে ভুয়া গেজেটপ্রাপ্ত হয়েছে এমন অভিযোগ এলেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। জুলাই শহীদ ও জুলাই যোদ্ধাদের তালিকা স্বচ্ছ রাখতে আমরা কাজ করছি। এখানে কোনো অনিয়মের সুযোগ নেই। আগামীতেও অভিযোগ আসলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আপনার মতামত লিখুন :