অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নানা কার্যক্রমের তথ্য তুলে ধরেছেন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে এ কথা বলেন তিনি।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের আইন মন্ত্রণালয় গত এক বছরে যা করেছে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকার এত কম সময়ে এতগুলো কাজ করতে পারেনি। তারা আইন সংস্কার করেছে, ডিজিটালাইজ করেছে, হাজার হাজার হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করেছে।’
তিনি জানান, ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মূলত জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায় আসে। তার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রণালয় এক বছরে নিচের গুরুত্বপূর্ণ চারটি খাতে দৃষ্টান্তমূলক অগ্রগতি সাধন করেছে।
১. আইনি সংস্কার
ক) আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে আইনের আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা হয়েছে।
গুমকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা, অভিযুক্তের অধিকার, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগ, সরাসরি সম্প্রচার, আপিল, সাক্ষী নিরাপত্তা এবং ক্ষতিপূরণ-সংক্রান্ত বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
খ) সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫ প্রণয়ন করে স্বতন্ত্র জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে, যেখানে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বিচারপতি নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে।
গ) দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধন করে সাক্ষ্যগ্রহণে এফিডেভিট চালু, অনলাইনে সমন জারি ও একই মামলায় রায় কার্যকর করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ঘ) ফৌজদারি আইন সংস্কারে রিমান্ড ও গ্রেপ্তার প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করা হয়েছে। তদন্ত, মিথ্যা মামলা এবং অভিযুক্তের অধিকার-সংক্রান্ত ধারাগুলো সংশোধন করা হয়েছে।
ঙ) মামলা-পূর্ব বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার বিধান যুক্ত করা হয়েছে এবং প্রতি জেলায় লিগ্যাল এইড অফিসে ৩ জন বিচারক পদায়ন করা হয়েছে।
চ) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সময়সীমা নির্ধারণ, তদন্তে ব্যর্থতার দায় নির্ধারণ, সাক্ষীর নিরাপত্তা, পৃথক ট্রাইব্যুনাল ও পুরুষ শিশু নিপীড়নকে অপরাধ হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে।
ছ) পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বিধিমালায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের জন্য সহজীকরণ করা হয়েছে।
জ) সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করে আগের নিপীড়নমূলক ধারাগুলো বাতিল এবং মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
ঝ) বিবাহ নিবন্ধন বিধিমালায় জেন্ডার বৈষম্য বিলুপ্ত ও অনলাইন নিবন্ধনের বিধান চালু হয়েছে।
২. প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও ডিজিটালাইজেশন
ক) বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা, ২০২৫ অনুযায়ী সুপ্রীম কোর্টকে বিচারকদের পদ সৃষ্টির ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে এবং সরকারের বিভাগে পদায়নের নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে।
খ) দেশের প্রতিটি আদালত প্রাঙ্গণে তথ্য ও সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
গ) আদালতের কর্মচারী নিয়োগ এখন জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
ঘ) বিচারকদের সম্পত্তির হিসাব গ্রহণ ও সাবরেজিস্ট্রারদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রম চালু করা হয়েছে।
ঙ) আইন মন্ত্রণালয়ে প্রসিকিউশন মনিটরিং সেল গঠিত হয়েছে।
চ) ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেটদের অনলাইন সাক্ষ্যগ্রহণে Supreme Court Practice Directions জারি করা হয়েছে। ই-ফ্যামেলি কোর্ট চালুর কার্যক্রমও চলমান।
ছ) ৫০% সরকারি ফাইল ডিজিটাইজড করা হয়েছে; Attestation সেবাকে শতভাগ অনলাইন করা হয়েছে।
জ) অনলাইন বেইলবন্ড সিস্টেম চালু করার জন্য সফটওয়্যার প্রস্তুত। পরীক্ষামূলক ব্যবহার শিগগিরই শুরু হবে।
৩. হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার
জেলা কমিটি ও কেন্দ্রীয়ভাবে যাচাই শেষে ১৫,০০০-এর বেশি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে।
সাইবার আইনের অধীনে দায়ের হওয়া ৪০৮টি স্পিচ অফেন্স এবং গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ৭৫২টি মামলাও প্রত্যাহার হয়েছে। এর ফলে লক্ষাধিক রাজনৈতিক কর্মী ও নাগরিক হয়রানি থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
৪. দৈনন্দিন কার্যক্রম ও প্রশাসনিক অগ্রগতি
- মন্ত্রীপর্যায়ে ১২৮৩টি নথি নিষ্পত্তি (গত সরকারের সময় ৮৩৪টি)।
- ৩৯১টি বিষয়ে আইনগত মতামত (পূর্বে ১৮০টি)।
- ১.৬ লাখের বেশি ডকুমেন্ট সত্যায়ন (পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ)।
- রেকর্ড ১২টি অংশীজন মতবিনিময় সভা।
- বিভিন্ন কমিশনকে সাচিবিক সহায়তা।
- আইন ও প্রবিধান কোডিফিকেশনের কাজ শুরু।
- ৪৮৮৯ জন সরকারি আইন কর্মকর্তা, ২৭৪ জন এটর্নি এবং সুপ্রিম কোর্টে ২৮ জন বিচারপতির নিয়োগে সহায়তা।