রাজধানীর রামপুরায় গত ১৯ জুলাই ২০২৪-এর সহিংসতার ঘটনায় বিজিবিকে এককভাবে দায়ী করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ‘দ্যা ডেইলি স্টার’ এর মতন একটি মূলধারার পত্রিকার মাল্টিমিডিয়ায় আংশিক সত্য নিয়ে এমন মনগড়া, ভিউ প্রত্যাশী একটি প্রতিবেদন আমাদের বিষ্মিত করেছে।
টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের ফরেনসিক গবেষণার বরাত দিয়ে “Anatomy of BGB Shootings in Rampura”- শীর্ষক প্রতিবেদনে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কে একতরফাভাবে দোষারোপ করা হয়েছে।
বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থার অধীনে গণঅভ্যুত্থান সময়কালীন বিভিন্ন হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চলমান রয়েছে। উক্ত বিচারকার্য সম্পন্ন করার জন্য বিজিবিও সম্পূর্ণভাবে সহযোগিতা প্রদানের জন্য প্রস্তুত। এমন এক সময়ে কিছু তদন্তনাধীন ও বিচারাধীন বিষয়কে নাটকীয়ভাবে আনা হলো যখন প্রত্যন্ত গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে বিজিবি সীমান্তে মাথা উঁচু করা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের প্রতিবাদ বা সাম্প্রতিক পুশ ইন প্রতিরোধে অসামান্য অবদান রাখার পর বাহিনীর মনোবল ভাঙতে আংশিক সত্য নিয়ে এই একপেশে রিপোর্টটি করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান।
গত ১৯ জুলাই ২০২৪ এ রামপুরায় বিজিবির পাশাপাশি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি), র্যাব ও আনসার সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও শুধুমাত্র বিজিবিকে এককভাবে দায়ী করার বিষয়টি উক্ত প্রতিবেদনের পক্ষপাতিত্বকে সুষ্পষ্টভাবে প্রতীয়মান করেছে।
আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতায় পরিচালিত তথাকথিত এই যৌথ অনুসন্ধান মূলত নির্বাচিত ফুটেজ ও অনুমাননির্ভর বর্ণনায় গড়ে উঠেছে, যার প্রধান অসংগতি সমূহ তুলে ধরা হলো-
১। বিজিবি সদস্যের ফায়ারিং এ গুলিবিদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে:
প্রতিবেদনের শুরুতে কমলা রংয়ের টি শার্ট পরিহিত যুবক রমজান এর গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য প্রদর্শিত হয়। ভিডিওর ৩১ সেকেন্ডে প্রদর্শিত ফুটেজটি নিঃসন্দেহে কোন বহুতল ভবনের ওপর থেকে রেকর্ডকৃত। কে বা কারা যুবক রমজানের দিকে অস্ত্র তাক করেছিল তার সুনির্দিষ্ট তথ্য/প্রমান ভিডিওটিতে অনুপস্থিত। এ ছাড়াও রমজানের চারপাশে আরও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ থাকায় আপাতভাবে মনে হচ্ছে তাকে কোন ছাদ থেকে অথবা উঁচু কোন স্থান থেকে গুলি করা হয়েছে, তা না হলে তার গায়ে না লেগে তার চারপাশে যারা রয়েছে, তাদের কারো গায়ে লাগার কথা। জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার মানসে বিজিবি’র দিকে আঙ্গুলী প্রদর্শনপূর্বক ফুটেজটির অবতারণা করা হয়েছে। এ ছাড়াও ভিডিওর ১ মিনিট ১০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত দেখানো হয়েছে অন্য একটি বাহিনীর ফায়ারিং এর দৃশ্য।
টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটে ২০০ ছবি ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষনে ওই বাহিনীর সদস্যদের ফায়ারিংয়ের চিত্র দৃশ্যায়িত হলেও অজানা কোন এক কারণে বাহিনীটির নাম উচ্চারিত হয়নি।
২। ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতি নিয়ে অপতথ্য:
১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সমগ্র দেশে পূর্ববর্তী সরকারের আদেশে বিজিবি মোতায়েন করতে হয়েছিল দণ্ডবিধি ১৮৯৮-এর ১২৮-১৩২ ধারা ও ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফ্লস রেগুলেশন ১৯২২-এর ৩১০, ৩১০-এ অনুযায়ী। প্রতিবেদনে ম্যাজিস্ট্রেট অনুপস্থিত থাকার দাবি করা হয়েছে, অথচ সরকারি নথিতে উক্ত তারিখে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটদের পূর্ণ তালিকা বিদ্যমান ও আদালতে উপস্থাপিত। ফুটেজে ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখা যায়নি মানে এই নয় যে তিনি/তারা সেখানে ছিলেন না।
৩। গুলির পরিমাণ নিয়ে বিভ্রান্তি:
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বিজিবি কর্তৃক ৯৭২ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছে। তবে এর মধ্যে যে বিজিবির ধ্বংসপ্রাপ্ত/পুড়ে যাওয়া জীপের অভ্যন্তরে থাকা ৬০০ রাউন্ডের বেশি গোলাবারুদ ছিল, তা উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ উল্লেখিত গুলির মধ্যে অধিকাংশই পুড়ে যাওয়া গাড়ির অভ্যন্তরে রাখা ধ্বংসপ্রাপ্ত গুলি এবং উর্ধ্বমুখে ছোড়া অধিকাংশ ফাঁকা গুলি ছিল।
৪। শক্তি প্রয়োগ সংক্রান্ত অন্যান্য কিছু বিষয়:
বিজিবির কোনো ‘র্যাপিড অ্যাকশন টিম মাঠে নামেনি, এএমজি কিংবা কোনো ভারী অস্ত্র গাড়ির ছাদে বসানো হয়নি, কোথাও বালুর ব্যারিকেডও গড়ে তোলা হয়নি, আন্দোলনের বিরুদ্ধে কোনো হেলিকপ্টার ব্যবহার করেনি। যখন গণগ্রেপ্তারের আদেশ হয়েছিল তখনো বিজিবির কোনো টহল একজন ব্যক্তিকেও গ্রেপ্তার করেনি। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত বিজিবির কোনো স্থাপনায় কোনো বিতর্কিত ব্যক্তিবর্গকে আশ্রয় গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি।
৫। বিনা উস্কানিতে গুলি তত্ত্ব ভিত্তিহীন
ভিডিও বিশ্লেষণ বলছে-৫ মিনিটের ব্যবধানে ইট-বাঁশ-পেট্রলবোমা নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরই বিজিবি সতর্ক-ফায়ার দেয়। পুলিশের ব্যর্থতায় স্থানীয় প্রশাসন জরুরি ভিত্তিতে বিজিবির সহায়তা চায়, যা প্রতিবেদক নিজের ভাষ্যেই স্বীকার করেছেন। অথচ পূর্ণ প্রেক্ষিত বাদ দিয়ে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ক্লিপ তুলে ধরে ‘বিনা উস্কানিতে গুলি’ শীর্ষক উপসংহারে উপনীত হওয়া নিতান্তই সাংঘর্ষিক।
৬। জন-সমর্থনের চিত্র
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থাপনাসমূহ আন্দোলনকারীদের দ্বারা আক্রান্ত হলেও সারা দেশে বিজিবির সকল ক্যাম্পসমূহ অক্ষত ছিল। রামপুরা, বাড্ডা, গুলশানসহ বহু এলাকায় টেলিভিশন ফুটেজে দেখা যায় ছাত্র-জনতা বিজিবির টহলকে আক্রান্ত করেনি, বরঞ্চ অনেক স্থানে একই সঙ্গে বিজিবি ও ছাত্র-জনতাকে সহমতে সংহতি প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছে। বিজিবির দুই একজন সদস্য যাকে/যাদেরকে প্রচলিত নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বল প্রয়োগ করতে দেখা গেছে, তার/তাদের কারণে একটি বাহিনীকে সামগ্রিকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘণকারী বলতে হলে দৃঢ়, যাচাইকৃত প্রমাণ দরকার, যেটি রিপোর্টে পূর্ণাঙ্গভাবে অনুপস্থিত।
এ ছাড়াও উল্লেখ্য যে, এক্ষেত্রে বিজিবি কর্তৃক দ্রুততার সঙ্গে ঘটনার দুই মাসের মধ্যেই প্রাথমিক তদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে।
৭। এডিটকৃত গুলির শব্দ সংযোজন
প্রতিবেদনের ১৪:২৪ মিনিটে ৩ জন বিজিবি সদস্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তবে এডিটকৃত গুলির শব্দ সংযোজন করে এখানে একটি নাটকীয় সাউন্ড ইফেক্ট আনার অপচেষ্টা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বিজিবির সদস্যরা অনেক পরিমাণ গুলি করছেন মর্মে ভুল দৃশ্য উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে।
৮। প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন
এমন এক সময়ে কিছু তদন্তাধীন বিষয়কে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করা হলো যখন প্রত্যন্ত গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে বিজিবি সীমান্তে মাথা উঁচু করা নতুন বাংলাদেশকে দেখাচ্ছে গর্বিত দেশবাসীর এগিয়ে যাবার স্বপ্ন। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্গন করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের প্রতিবাদ ও সাম্প্রতিক পুশ ইন প্রতিরোধে অসামান্য অবদান রাখার পর বাহিনীর মনোবল ভাঙতে এই একপেশে প্রতিবেদনে শুধুমাত্র বিজিবিকে দায়ী করা হয়েছে বলে ধারণা করা যায়।
রামপুরার ঘটনায় প্রাণহানি নিশ্চিতই বেদনাদায়ক এবং কোনভাবেই মানা যায় না। দোষী ব্যক্তির অবশ্যই শাস্তি প্রাপ্য। তবে যে কোনো তদন্তে সততা কাম্য। নির্বাচিত ফুটেজ, অনুমান ও আংশিক তথ্য নিয়ে রচিত গল্পকে ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং’ বলা যায় না। সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ায় যদি কোনো বিজিবি সদস্য দোষী প্রমাণিত হন, তার শাস্তি বিধানের বিষয়ে বিজিবিও সম্পূর্ণ একমত।
বিডিআর বিদ্রোহের ক্ষত কাটিয়ে বিজিবি যখন পুনর্গঠিত হয়ে বর্তমানে একটি দক্ষ বাহিনী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছে ঠিক তখনই বিজিবির মতো একটি First Line Defence Force এর মনোবল ভাঙার দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার একটি অংশ বলে প্রতীয়মান। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মনোবলকে দুর্বল করে দিলে কার লাভ বেশি? এর মধ্যে দেশের বাইরের কারো কি ইন্ধন রয়েছে?
আপনার মতামত লিখুন :