মাত্র ৩৩ বছর বয়সে মালদ্বীপে বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তরুণ শিক্ষাবিদ ও গবেষক ড. মো. নাজমুল ইসলাম। এই অভাবনীয় নিয়োগে দেশের কূটনৈতিক মহল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন পর্যন্ত বিস্তর আলোড়ন তৈরি হয়েছে। কেউ বলছেন এটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, কেউ আবার তুলছেন রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দ ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন।
নাজমুল ইসলামের যাত্রাপথ শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগে। ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়ে ২০১৪ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন।
এরপর তুরস্ক সরকারের বৃত্তি পেয়ে আঙ্কারায় যান পিএইচডি করতে। সেখানেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করে আঙ্কারা ইলদিরিম বেয়াজিট বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।
পরবর্তীতে তুর্কি পার্লামেন্টে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান -একটি শত বছরের ইতিহাসে প্রথম কোনো বিদেশির সম্মান। পাশাপাশি তিনি জাতিসংঘ, ওআইসি ও ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের নানা গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
তাঁর গবেষণাপত্র ও লেখা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে আছে -হার্ভার্ড, এমআইটি, অক্সফোর্ডের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে তাঁর লেখা। ‘পাওয়ার অব বন্ডিং’ নামে একটি তত্ত্ব আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে। ক্যামব্রিজ, ব্র্যাকসহ বহু গবেষণা প্রকল্পে যুক্ত থেকেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন সার্ভিস ইনস্টিটিউটেও অতিথি বক্তা হিসেবে কাজ করছেন।
তবে তাঁর অতীতও কম আলোচিত নয়। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৩ সালে ছাত্রদল সংশ্লিষ্টতার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে বিদেশে পাড়ি জমান তিনি।
হাত-পা ভাঙা অবস্থায় দেশ ছেড়ে যাওয়ার সেই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তই তাঁকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে গবেষণায় উৎসাহিত করে। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় তিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সরব ভূমিকা রাখেন -যা তাঁকে ‘নতুন প্রজন্মের কণ্ঠ’ হিসেবে পরিচিতি দেয়।
এই সাহসী ও প্রতিভাবান তরুণকে যখন সরকার মালদ্বীপে রাষ্ট্রদূত হিসেবে চুক্তিভিত্তিক দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয়, তখন সেটা অনেকের চোখে অনুপ্রেরণার উৎস হলেও, কূটনৈতিক মহলে প্রশ্নও তুলেছে।
রাষ্ট্রদূতের মতো পদে বয়স, অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা -এই তিনটি বিষয় সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়। যেখানে নাজমুলের বয়স মাত্র ৩৩, পেশাদার কূটনীতিক না হয়েও এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়ায় অনেকে এটিকে রাজনৈতিক ‘তদবির’-এর ফল বলছেন।
সমালোচনার বড় একটি দিক হলো তাঁর ব্যক্তিগত জীবন -যেখানে উঠে এসেছে, তিনি তুরস্কে বিয়ে করেছেন, তাঁর স্ত্রী সে দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব। এই কারণে কেউ কেউ ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’-এর প্রশ্ন তুলছেন এবং জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এই নিয়োগ পুনর্বিবেচনারও দাবি করছেন।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর ও মুন্সী ফয়েজ আহমেদরাও বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন। একজন বলছেন, ‘রাষ্ট্রদূত এমন পদ যেখানে রাজনৈতিক পছন্দ নয়, প্রয়োজন অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি’, অন্যজন বলছেন, ‘মালদ্বীপে কাজ করাটা সহজ নয়, বিশেষ করে চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বীতার জটিল পরিবেশে’।
তবে তাঁর ঘনিষ্ঠরা বলছেন ভিন্ন কথা। সহপাঠী, শিক্ষক ও সহকর্মীরা তাঁকে অত্যন্ত মেধাবী, দৃঢ়চেতা ও আন্তর্জাতিক মানের গবেষক হিসেবে অভিহিত করেছেন। একাধিক ফেসবুক পোস্টে তাঁকে ‘নতুন নেতৃত্বের প্রতীক’ ও ‘বুদ্ধিবৃত্তিক কূটনীতির প্রতিনিধি’ হিসেবে প্রশংসা করা হয়েছে।
এখন দেখার বিষয়, রাজনৈতিক বিতর্কের ছায়া এড়িয়ে এই তরুণ রাষ্ট্রদূত তাঁর অভিজ্ঞতা, মেধা ও আন্তর্জাতিক প্রজ্ঞা দিয়ে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের সম্পর্ককে কোথায় নিয়ে যেতে পারেন। যাত্রাপথ শুরু হয়েছে, সামনে অপেক্ষা করছে ইতিহাস রচনার সুযোগ।