মাইলস্টোনের স্মৃতি এখনো সবার মধ্যে দগদগে হয়ে আছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষক মাহেরীন চৌধুরী, মাসুকা বেগম ও মাহফুজা খাতুন মানবতা ও সাহসিকতার প্রতীক হিসেবে জাতির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তিন শিক্ষকের স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন শিক্ষক মাহেরীন চৌধুরীর স্বামী মনসুর হেলাল, দুই ছেলে আদিল রশিদ ও আয়ান রশিদ, বোন মেহেতাজ চৌধুরী, ভাই মুনাফ মজিব চৌধুরী এবং নিকট আত্মীয় কাওসার হোসেন চৌধুরী। শিক্ষক মাসুকা বেগম ও মাহফুজা খাতুনের পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বেশ কিছুদিন পার হলেও এই স্মৃতি এখনো সবার মধ্যে দগদগে হয়ে আছে। আমি ঘটনা জানামাত্রই আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনারা যে দুঃসময়ের মধ্যে ছিলেন, সেই সময় দেখা করা সমীচীন হতো না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আপনাদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করতে পারি, কিন্তু এই দুঃসহ স্মৃতি মুছে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, এ শোক আপনাদের একার নয়—জাতি হিসেবে আমরা এই শোক ধারণ করি।’
এ সময় তিন শিক্ষক পরিবারের কাছে তাদের স্মৃতিকথা শুনতে চান প্রধান উপদেষ্টা। শিক্ষক মাহেরীন চৌধুরী’র স্বামী মনসুর হেলাল স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘যখন তাকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল তখন ফোনে আমার সঙ্গে কথা হয়। বার্ন ইনস্টিটিউটে যে দৃশ্য দেখেছি, তা ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। জীবনে যেন কারও সেই অভিজ্ঞতা না হয়।’
তিনি বলেন, “আমি তাকে দেখলাম, একপাশ পুরোটা পুড়ে গেছে। সেখানে কয়েকজন সামান্য দগ্ধ বাচ্চা চিকিৎসা নিতে নিতে বলল, ‘মিসই আমাদের টেনে টেনে বের করে আনল! মিস তো সুস্থ ছিল! এমন হলো কেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি বের হয়ে এলে না কেন? তোমার নিজের দুই সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না?’ সে বলল, ‘ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি?’ পৃথিবীর সকল মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তার জন্য দোয়া করেছে। সবার জন্যই সে নিবেদিত প্রাণ ছিল।”
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ২৪ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ১৪ অগাস্ট মারা যান মাহফুজা খাতুন। তার মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা মায়ের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং বলেন, ‘আমার মা অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠেছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরব। মাকে যখন হুইলচেয়ারে বসাই, মনে হলো আমি বিশ্বজয় করেছি। মা ছাড়া একেকটা দিন আমার জন্য দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। আমার তো বাবা নেই, এখন মা চলে গেল। আমি এতিম হয়ে গেলাম। এখন পর্যন্ত নিজের বাসায় ফিরতে পারিনি। মা ছাড়া সেই বাসায় ফিরব কীভাবে?’
শিক্ষক মাসুকা বেগমের ভগ্নিপতি খলিলুর রহমান বলেন, ‘দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অনেক দিন ধরে তার বোন অসুস্থ, চোখে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। মাসুকা সবসময় তার বাবা ও বোনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত এবং তাদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চটুকু দেওয়ার চেষ্টা করত। বাবাকে নিয়মিত হাত খরচ পাঠাত এবং আমার সন্তানদের সে নিজের সন্তানের মতো ভাবত। প্রতিদিন তাদের সঙ্গে তার কথা হতো। আমাদের স্কুল এবং শিক্ষার্থীরাই ছিল তার জীবন।’
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তাদের কথা শুনতে কষ্ট লাগে, একইসঙ্গে গর্ববোধও হয়। আমাদের দেশে এমন নাগরিক আছে, যারা অন্যের জীবন বাঁচাতে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছেন। মানবতার এ দৃষ্টান্ত তারা প্রমাণ করেছেন।’
তিনি বলেন, “আমরা ক্ষুদ্র মানুষ হতে পারি, কিন্তু তারা আমাদের বড় করেছেন। সবাই এটা অনুভব করেছে যে, ‘আমি যদি সেই অবস্থানে থাকতাম, আমি কি জীবনের পরোয়া না করে ছোট শিশুদের প্রাণ বাঁচাতে আত্মবিসর্জন দিতাম?’ এই প্রশ্ন সবার মনে এসেছে।”
তিনি আরও বলেন, ‘এসব শিক্ষক আমাদের গর্ব, আমাদের আদর্শ। তাদের স্মৃতি আমাদের ধরে রাখতে হবে। এজন্য যা-কিছু করা প্রয়োজন, আমরা তা করব।’
এ সময় যমুনায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং প্রধান উপদেষ্টার এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন