ঢাকা সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫

সেপ্টেম্বরে খাদ্য সহায়তা কমার শঙ্কা, ১৩ লাখ রোহিঙ্গা সংকটে

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৫, ০৭:৪৩ পিএম
১৮ মাসে দেড় লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ, সীমান্তে অপেক্ষায় আরও অর্ধলাখ। ছবি- সংগৃহীত

গত ১৮ মাসে নতুন করে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। জানা গেছে, সীমান্তে আরও প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে, যারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সহিংসতা ও অস্থিরতা থেকে পালিয়ে এসেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩ লাখে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই অবস্থান করছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে এবং বাকিরা ভাসানচরে।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মাথাপিছু মাসিক খাদ্য সহায়তা ১২ ডলার (কক্সবাজার) এবং ১৩ ডলার (ভাসানচর) নির্ধারণ করেছে, যা ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বহাল থাকবে। তবে আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে বরাদ্দ নির্ধারণ করা হবে।  এরই মধ্যে সহায়তা কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, ‘ডব্লিউএফপির কাছে নভেম্বর মাসের জন্যও খাদ্য তহবিল নিশ্চিত নয়। এলপিজি সরবরাহেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যা বন উজাড় বাড়িয়ে দিতে পারে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্য ও ন্যূনতম সহায়তা নিশ্চিত না হলে শরণার্থীদের মধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে, একই সঙ্গে সামাজিক অস্থিরতাও প্রকট আকার ধারণ করবে। এই সংকট শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াসহ আসিয়ান দেশগুলোর জন্যও হুমকি হতে পারে।

কক্সবাজারে গত ২৪ থেকে আগামীকাল ২৬ আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘স্টেকহোল্ডারস ডায়ালগ’, যা সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনের প্রস্তুতিমূলক সংলাপ। এতে অংশ নিয়েছেন দেশি-বিদেশি কূটনীতিক, মানবাধিকার কর্মী, রোহিঙ্গা প্রতিনিধি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যরা। দ্বিতীয় দিনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

ডায়ালগে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও যুবকদের অভিজ্ঞতা এবং প্রত্যাশার ওপর। অংশগ্রহণকারীরা সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন, যাতে বাস্তব চিত্র তুলে ধরা যায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে।

রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে আরাকান আর্মি ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। নাইক্ষ্যংছড়ি ও টেকনাফ সীমান্তের ওপার থেকে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান। গত শুক্রবার রাতে হোয়াইক্যং সীমান্ত লাগোয়া গ্রামে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, যা শনিবার ভোর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।

টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান জানান, ‘সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি তৎপর রয়েছে। গত শুক্রবার ৬২ জন রোহিঙ্গাকে সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে প্রতিহত করা হয়েছে। তবে ওপারে হাজারো রোহিঙ্গা এখনো অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে।’

এদিকে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তা পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। গত চার বছরে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা কেন্দ্র করে আটটি গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত ২০২ জন নিহত হয়েছেন। এসব গ্রুপের মধ্যে রয়েছে: আরসা, আরএসও, এআরএ, মাস্টার মুন্না গ্রুপ, ডাকাত সালমান গ্রুপ, ডাকাত সাদ্দাম গ্রুপ ও দীল মোহাম্মদ ওরফে মার্স গ্রুপ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যাম্পগুলো এখন অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকায় উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতি মাসেই অন্তত একটি করে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ড. তানভীর হোসেন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সহায়তা না বাড়লে মানবিক বিপর্যয় আরও ভয়াবহ হবে। এতে শুধু রোহিঙ্গা নয়, স্থানীয় জনগণও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চাচ্ছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় টাস্কফোর্স বৈঠকেও এই সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদারের আহ্বান জানানো হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্য, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, শিক্ষাসহ সবক্ষেত্রে টেকসই আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা ছাড়া এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে আসন্ন নিউইয়র্ক ও দোহা সম্মেলন হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম