আজ শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। অন্তর্বর্তী সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানটিকে দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রায় এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসন ও ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর এটি একটি নতুন রাজনৈতিক চুক্তির প্রতিফলন, এর উদ্দেশ্য হলো গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গঠন এবং ভবিষ্যতের স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা প্রতিরোধ।
সনদের প্রেক্ষাপট
জুলাই জাতীয় সনদের পেছনে রয়েছে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট। ছাত্র, শ্রমিক ও নাগরিকদের নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলনে ১,৫০০-এর বেশি মানুষ নিহত ও ৩০,০০০-এর বেশি আহত হন। এই আন্দোলনের ফলেই ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটে এবং গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। পরবর্তী সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। মার্চ থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত আট মাসে কমিশন ৬৭টি বৈঠকে বসে এবং ৩৩টি দল লিখিত মতামত দেয়। অবশেষে রাষ্ট্র পরিচালনার ১৭টি খাতে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে প্রায় ২০ পৃষ্ঠার একটি সনদ তৈরি হয়, যা পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত।
জুলাই সনদের মূল উপাদান
সনদের প্রথম অধ্যায়ে উপস্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস—ব্রিটিশ শাসন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সামরিক শাসনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। বিশেষভাবে ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলকে সনদে ‘ফ্যাসিবাদী’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে ছয়টি সংস্কার কমিশনের কাজের বিবরণ দেওয়া হয়েছে—যেগুলো সংবিধান, নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতিবিরোধী খাত নিয়ে গঠিত হয়েছিল। শেষ অধ্যায়ে রয়েছে সনদ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি, শহীদ ও আহতদের সম্মান ও ক্ষতিপূরণ এবং ভবিষ্যতের জন্য স্বচ্ছ নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণের অঙ্গীকার।
সনদ চূড়ান্তকরণের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপে অংশ নেয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবে বিস্তৃত ঐকমত্য তৈরি হয়। যেমন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন—এ প্রস্তাবে ৩০টি দল একমত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার, স্বাধীন পুলিশ কমিশন, উচ্চ নারী প্রতিনিধিত্ব, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ট্রুথ কমিশনের মতো প্রস্তাবেও রয়েছে ব্যাপক সম্মতি। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতভেদ রয়ে গেছে এবং সেগুলোর পাশে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ যুক্ত করে সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিতর্ক ও বিরোধিতা
যদিও কমিশন দাবি করেছে, এটি একটি ‘জাতীয় ঐকমত্যের দলিল’, কিন্তু বিতর্ক একেবারে অনুপস্থিত নয়। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সনদে আইনি ভিত্তি না থাকার অভিযোগ এনে অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। দলটি জানিয়েছে, তাদের তিনটি প্রধান দাবি পূরণ না হলে তারা সনদে স্বাক্ষর করবে না, যার মধ্যে রয়েছে—সনদ বাস্তবায়নের নির্বাহী আদেশ, গণভোট এবং আইনি প্রতিশ্রুতি। বামপন্থি চারটি দল—সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ দাবি করেছে, সনদের পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে এবং সংবিধানের মূল চার নীতির প্রতি অঙ্গীকার স্পষ্ট নয়। তারা আদালতের বিষয়ে অনাক্রম্যতার মতো শর্তেরও বিরোধিতা করে সনদে স্বাক্ষর না করার ঘোষণা দিয়েছে।
দলগুলোর অবস্থান
বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ৩৩টি দল সংলাপে অংশ নিলেও সবার অবস্থান এক নয়। বিএনপি জানিয়েছে, ‘নোট অব ডিসেন্ট’-এর বিষয়গুলো সনদে লিপিবদ্ধ করা হলে তারা স্বাক্ষর করবে। জামায়াত অনুষ্ঠান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলেও স্বাক্ষরের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এনসিপি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আইনি ভিত্তি না থাকলে তারা স্বাক্ষর করবে না।
অন্যদিকে, বাম দলগুলো অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, আজ স্বাক্ষর না করলেও ভবিষ্যতে যেকোনো সময় দলগুলো স্বাক্ষর করতে পারবে।
গণভোট নিয়ে বিতর্ক
সনদে বাস্তবায়নের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো সুপারিশ না থাকলেও বলা হয়েছে, যেসব সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত বাস্তবায়ন করবে। ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৪৭টি সংবিধান সংশোধন করে এবং ৩৭টি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য। গণভোট বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও সময় ও পদ্ধতি নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। বিএনপি চায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট হোক, জামায়াত ও এনসিপি চাইছে নভেম্বরে, নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠিত হোক।
কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সব দল গণভোটে একমত হয়েছে। তবে কবে, কীভাবে এবং কোন বিষয়গুলোতে গণভোট হবে, তা এখনো নির্ধারিত নয়। কমিশনের একজন সদস্য জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন সরকারের পরামর্শে গণভোট আয়োজন করবে।