ঢাকা সোমবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৫

মনোনয়ন ঘোষণার পর বিএনপিতে তিন খুন

আসাদুজ্জামান তপন
প্রকাশিত: নভেম্বর ১০, ২০২৫, ০১:৪১ পিএম
ছবি- সংগৃহীত

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে মনোনয়ন ঘোষণা করা হয়েছে গত ৩ নভেম্বর। মনোনয়ন ঘোষণার পর কেটেছে মাত্র এক সপ্তাহ। এরই মধ্যে দলীয় কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। রাওজান, ময়মনসিংহের গৌরীপুর ও মুন্সীগঞ্জে পৃথক সংঘর্ষে নিহত হয়েছে তিনজন।

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির ভেতরে অস্থিরতা দিন দিন চরমে পৌঁছাচ্ছে। ঘোষিত মনোনয়নপত্র বণ্টনের পর রাওজান, ময়মনসিংহের গৌরীপুর ও মুন্সীগঞ্জে সংঘর্ষে তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনাই এর সাম্প্রতিক উদাহরণ। এসব সংঘর্ষের ঘটনায় দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির সাংগঠনিকভাবে দুর্বলতা ও অস্থিতিশীলতার প্রকাশ পাচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং হাইকমান্ডের সঙ্গে তৃণমূলের দুর্বল যোগাযোগই বারবার এমন সংকট তৈরি করছে। প্রার্থীদের মনোনয়ন নিয়ে অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ দলীয় কর্মীদের মধ্যে হতাশা ও বিভক্তির জন্ম দেয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সহিংসতায় রূপ নেয়। এতে শুধুই প্রাণহানি হয় না, বরং স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির প্রভাব ও গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে কোনো দল যদি কাঠামোগত দক্ষতা ও দলীয় নিয়ন্ত্রণ ঠিক রাখতে না পারে, তবে ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিচালনায় তার অযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

এ ধরনের সহিংসতা শুধু দলীয় ক্ষতিই ডেকে আনে না; এতে সাধারণ ভোটারও দূরে সরে যায়, দলের প্রতি জনআস্থা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং নির্বাচনি মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দুর্বল হয়। যেখানে প্রতিপক্ষ দলগুলো এখনো নিরবচ্ছিন্নভাবে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করছে, সেখানে বিএনপির এ ধরনের অভ্যন্তরীণ সংকট দলটির ভবিষ্যৎ টিকে থাকা এবং নির্বাচনি সক্ষমতার প্রশ্নও জাগিয়ে তুলছে।

গত ৬ দিনে ঘটে যাওয়া সংঘর্ষের ঘটনাগুলো

৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের রাওজানে চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর জনসংযোগের সময় সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে একজন নিহত এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে বিএনপি প্রার্থী ও মহানগর আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহসহ চারজন আহত হন।

নিহত মোহাম্মদ সারওয়ার হোসেন বাবলা পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী। ইদানীং তিনি নিজেকে বিএনপির কর্মী বলে দাবি করতেন। তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মহানগরের বিভিন্ন থানায় কমপক্ষে ১৮টি মামলা রয়েছে। তবে বিএনপি বলছে, সারওয়ার তাদের কেউ নন।

৯ নভেম্বর বিকেলে ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে দলীয় দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষে একজন নিহত এবং অন্তত ৬০ জন আহত হয়েছেন। গৌরীপুর পৌর শহরের পাটবাজার এলাকায় এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এম. ইকবাল হোসেন গৌরীপুর আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মনোনয়নবঞ্চিত আহমেদ তায়েবুর রহমান হিরনের সমর্থকদের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার এম. ইকবাল হোসেনের সমর্থকদের সঙ্গে উত্তেজনা বিরাজ করছিল।

বিকেল ৪টার দিকে নিজ নিজ মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে যাওয়ার সময় দুই পক্ষের মুখোমুখি সংঘর্ষ বাধে। দুই পক্ষই ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও লাঠিসোটা নিয়ে একে অপরের ওপর হামলা চালায়। সংঘর্ষে তানজির আহমদ আবিদ (২৮) নামে স্থানীয় ছাত্রদল নেতা নিহত হন।

আজ ১০ নভেম্বর মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মোল্লাকান্দি ইউনিয়নে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে গুলিতে আরিফ মীর (৩৫) নামে একজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আরও একজন গুলিবিদ্ধসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন।

এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আতাউর রহমান মল্লিক ও ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সহসভাপতি আওলাদ হোসেন গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। ওই বিরোধের জেরে সোমবার সকালে দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে।

এ সময় আওলাদ গ্রুপের সমর্থক আরিফ মীর গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

পরিশেষে বলা যায়, মনোনয়নসংশ্লিষ্ট সহিংসতা বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই কেবল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে না—এটি দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নেতৃত্বগত দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র সংকটেরও প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখবে জনগণ।