ঢাকায় গেড়ে বসা গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রভাবশালী প্রায় সব কর্মকর্তাকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হলেও প্রকৌশলী এ.কে.এম. সোহরাওয়ার্দীকে বদলি করা হয়নি। প্রায় ১৬ বছর ধরে তিনি আছেন ঢাকাতেই। এই ১৬ বছর ধরে তিনি গণপূর্ত অধিদপ্তরে গড়ে তুলেছে প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট। এ ছাড়াও তিনি পতিত হাসিনা সরকারের আমলে গণমাধ্যমেও কৌশলে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমানে তিনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জনসংখ্যা প্রকল্প কোষ (পিপিসি) ছাড়াও গণপূর্ত পেকু সার্কেলের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন।
অভিযোগ আছে, সোহরাওয়ার্দী পিপিসিতে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বিশেষ বরাদ্দের কাজে বরাদ্দ বেশি দেওয়ার নামে সারা দেশের নির্বাহী প্রকৌশলীদের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়াও তিনি গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েক হাজার কোটি টাকার চলমান উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কোটি ভেরিয়েশন দিয়েও মোটা অংকের কমিশন হাতিয়ে নিয়েছেন।
জানা যায়, তিনি ২০০৯ সালে আওয়ামী সরকারের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই শেরেবাংলা নগর-১ এ নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পোস্টিং বাগিয়ে নেন। শেখ রেহানার আশীর্বাদে প্রকৌশলী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদে বসেই তার অনুগত সোহরাওয়ার্দী নিজের স্টাফ অফিসার করেন। সোহরাওয়ার্দী এই পদে বসার পরেই গণপূর্তে টেন্ডার মাফিয়াখ্যাত ঠিকাদার জিকে শামীমের সহযোগী সাবেক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মোল্লা মোহাম্মদ কাউসার, যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট, বগা লিটন, জনি এদের আনাগোনাতে মুখর থাকত তার রুম। পরে রফিক প্রধান প্রকৌশলী হলে সোহরাওয়ার্দী আরও ক্ষমতাধর হয়ে উঠেন। এ সময় তিনি মূলত ডিফেক্টো চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।
এ ছাড়াও আওয়ামী শাসনের সবচেয়ে আশীর্বাদপুষ্ট আমলা পূর্ত-সচিব শহীদুল্লাহ খন্দকার গংয়ের সঙ্গে তিনি সখ্য গড়ে তোলেন। শহিদুল্লাহ, রফিক ও তৎকালীন মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ মিলে একটি দুর্নীতির নেক্সাস গড়ে তোলেন। এই নেক্সাস মিলে পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় আবাসিক প্রকল্প বানিয়ে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছেন। তারা একাধিকবার সিঙ্গাপুরে গিয়ে কয়েক মিলিয়ন ডলার সামিট গ্রুপকে দিয়ে এসেছেন। রফিকের হয়ে সব দেন-দরবার সোহরাওয়ার্দীই করতেন বলে জানা যায়।
পরে ক্যাসিনো কাণ্ডে জিকে শামীম গ্রেপ্তার হলে সোহরাওয়ার্দীসহ আরও ছয় প্রকৌশলীর টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায় দুদক। কিন্তু তিনি কোটি টাকার বিনিময়ে দুদক থেকে দায় মুক্তি নিয়ে নেন।
জানা যায়, শেখ সেলিমের সহযোগিতায় তিনি ঢাকা সার্কেল-১ এ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর চেয়ারে বসেন। রফিকের পরে শাহাদাত প্রধান প্রকৌশলী হলে সোহরাওয়ার্দীর ক্ষমতা আরও বেড়ে যায়। কিন্তু ২০২০ সালে আশরাফুল আলম প্রধান প্রকৌশলী হলে তার সঙ্গে বদলি বাণিজ্য ও মিডিয়া সিন্ডিকেট নিয়ে ব্যক্তিত্বের সংঘাত ঘটে। আশরাফ তাকে দিনাজপুর সার্কেলে বদলি করলেও তিনি সেখানে যোগদান করেননি এবং এক দিনের জন্যও যাননি। উল্টো আশরাফের বিরুদ্ধে মিডিয়া লেলিয়ে দেন।
ফলে আশরাফ সেই অর্ডার বাতিল করতে বাধ্য হন। সে যাত্রায় তিনি নিরাপদ প্রস্থান হিসেবে পিপিসির পোস্টিং বেছে নেন। সেখানে টাকা কামিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। শামীম আখতার চিফ ইঞ্জিনিয়ার হলে তিনি আবার মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়ে নেন। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি বিএনপি ঘরানার অফিসারদের ইচ্ছামতো বানোয়াট রিপোর্ট করিয়ে হয়রানি করিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
অভিযোগ আছে, জিকে শামীম গ্রেপ্তার হলে তিনি টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণ নিতে অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স ম্যানখ্যাত জেনারেল আজিজের ভাই জোসেফ, হারিস ও জিসানের সহায়তা নেন। তার বাড়ি চাঁদপুর হওয়ায় আজিজ পরিবারের সঙ্গে তার আগে থেকেই সখ্য ছিল। জেনারেল আজিজের ক্ষমতাবলে তিনি নিজের প্রয়োজনে একটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করতেন।
শামীম আখতার প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার পর তিনি শামীম আখতারের ঘনিষ্ট সহচর নূসরাত হোসেনের সঙ্গে মিলে বড় ঠিকাদারদের নিয়ে কন্ট্রাক্ট নিগোসিয়েশন করতেন। এভাবে তিনি শামীম আখতারের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। পরে শামীম আখতার তাকে সাভার সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী করেন। সে সময়ে সাভার সার্কেলের আওতায় বিশেষত মিরপুরে তিনি চুন্নুকে সঙ্গে নিয়ে এগারো হাজার কোটি টাকার টেন্ডার নিগোশিয়েসন করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
পরবর্তীতে মিরপুরে রাশেদ এলেও তার পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় ছিল। খ্যাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের ফার্ম নূরানী কন্সট্রাকশন, ফার্ম দেশ উন্নয়ন, ডেল্টা, বঙ্গ বিল্ডার্স, ওয়াহিদ মিয়া, স্টার লাইট, স্পেক্ট্রা, দ্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স, এন ডি ই লি., কুশলী নির্মাতা, দ্য ইঞ্জিনিয়ারস অ্যান্ড আর্কিটেক্ট এসব প্রতিষ্ঠানের গণপূর্তে কাজ পাওয়ার পেছনে সোহরাওয়ার্দীর হাত রয়েছে বলে জানা যায়। এভাবে টেন্ডারবাজি করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা।
হাসিনা সরকারের পতনের পরে এ.কে.এম. সোহরাওয়ার্দী আবারও সেই পুরোনো পিপিসিতেই সেইফ এক্সিট নিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প থেকে কয়েক কোটি টাকা লোপাট করছেন বলে গণপূর্ত সংশ্লিষ্টরা জানান। গণপূর্ত সংশ্লিষ্টরা তাকে রুপার্ড মারডক অব পিডব্লিউডি বলেও অভিহিত করেন।
এ বিষয়ে জনসংখ্যা প্রকল্প কোষের (পিপিসি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ.কে.এম. সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি।

-20251130145102.webp)

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন