পর্তুগালের পোর্তোর লিভরারিয়া লেলো- বিশ্বখ্যাত এই বইয়ের দোকানের কথা উঠলেই প্রথমে দুটি জিনিস মনে পড়ে। একটি হলো- দোরগোড়ায় দাঁড়ানো বাউন্সার। ঠোঁটে ভদ্র হাসি, আচরণ বিনয়ী, অথচ তার উপস্থিতিই বলে দেয়- এটি স্রেফ কোনো বইয়ের দোকান নয়; এটি বিশ্বের প্রথম বইয়ের দোকান যার দরজায় বাউন্সার পাহারা দেন।
১৯০৬ সালে খোলা লিভরারিয়া লেলোকে অনেকে মনে করেন বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর বইয়ের দোকান। নব্য-গথিক নকশার এই স্থাপত্যটির ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যায় কেন এর সুনাম এত দূর ছড়িয়ে গেছে। কাঠের মোলায়েম ঝলক, দেয়াল জুড়ে ওয়েইনস্কোটিং, মেঝের নিখুঁত ট্রেলিস-প্যাটার্ন, বইয়ের তাকের সারি- সব মিলিয়ে যেন শিল্পের এক জীবন্ত গ্যালারি। ছাদের অংশজুড়ে দাগযুক্ত কাচের লম্বা রঙিন প্যানেল আলো-আধাঁরের অপূর্ব খেলা তৈরি করে। আর দোকানের প্রাণ-রক্তিম বর্ণের আইকনিক সিঁড়ি- দর্শনার্থীদের চোখ আটকে রাখে বেশ কিছুক্ষণ। উপরের দেয়ালে ঝোলানো পোস্টারগুলোতে নোবেল পুরস্কার না-পাওয়া সাহিত্য মহাতারকাদের নাম- টলকিন, মঘাম, প্রুস্ট, রাউলিং, ক্যারল আর হার্পার লি- নীরবে ইতিহাসের আরেক গল্প বলে।
বাউন্সারকে পেরোনোই প্রথম পরীক্ষা হলে, ভেতরের ভিড় হলো দ্বিতীয়টি। পর্তুগালে এখন ক্রাউড-ফ্রি ‘শোল্ডার সিজন’—কিন্তু লিভ্রারিয়া লেলোর ভেতরে ঢুকলে তা বিশ্বাস করা কঠিন। এই ভিড় কি পর্যটকের, না বইপ্রেমীদের? তার উত্তর মেলে বিলিং কাউন্টারের সামনে লম্বা সাপের মতো সারিতে- মানুষ শুধু তাকিয়েই নেই, বই কিনছেও আগ্রহ নিয়ে।
ইংরেজি বইয়ের তাক ভর্তি রিচার্ড ওসমান, ড্যান ব্রাউন, কলিন হুভারসহ বর্তমানের জনপ্রিয় সব বেস্টসেলার। শিশুদের সংখ্যা যথেষ্ট, আর তাদের বেশিরভাগের হাতেই হ্যারি পটার। কারণটা সহজ- জে.কে. রাউলিং একসময় পর্তুগালে বসবাস করেছেন, এবং অনেকে মনে করেন লিভরারিয়ার অলংকৃত অভ্যন্তর তাকে হগওয়ার্টস বা ডায়াগন অ্যালির ভাবনায় অনুপ্রাণিত করেছিল। যদিও লেখক নিজে দৃঢ়ভাবে এ দাবি অস্বীকার করেছেন।
-20251201041553.png)
২০০৬ সালে স্প্যানিশ লেখক এনরিক ভিলা-মাতাস যখন বইয়ের দোকানটিকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর’ বলে আখ্যা দেন, তখন থেকেই লিভ্রারিয়ার জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। এখানকার জেমা সেকশন একচেটিয়াভাবে বিরল বই, পাণ্ডুলিপি, প্রথম সংস্করণ আর বিলাসবহুল বইয়ের সংগ্রহে ভরপুর। পর্তুগিজ সাহিত্যিক হোসে সারামাগোর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার নামে একটি বিশেষ কক্ষ রয়েছে, যেখানে নোবেলজয়ী এই লেখকের দুর্লভ সংস্করণগুলো সাজানো।
উপরের বামদিকের জানালায় ‘ও রোস্তো দো পোর্তো’- যেখানে পোর্তো শহরকে তুলে ধরা হয়েছে তার মানুষের মুখের মধ্য দিয়ে, সেলিব্রিটিদের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদেরও। কয়েক কদম এগোলেই নতুন চালু হওয়া লে পেটিট প্রিন্স রুম। আঁতোয়ান দ্য সেন্ট-এক্সুপেরির জাদুকরী বই দ্য লিটল প্রিন্স–কে কেন্দ্র করে সাজানো শিল্প স্থাপনাটি যেন ছোটদের জন্য স্বপ্নের খনি। সেখানে সংশ্লিষ্ট নানা সংগ্রহযোগ্য পণ্যও রয়েছে, বিশেষ করে বইটির ৮০তম বর্ষপূর্তির বিশেষ সংস্করণটি নজর কাড়ে।
লিভরারিয়ার রূপ, ঐশ্বর্য আর স্মৃতিকাতর সৌন্দর্যে হারিয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবু দর্শনার্থীদের বিনীত অনুরোধ করা হয় বেশি সময় না কাটাতে- একটি বইয়ের দোকান থেকে এমন অনুরোধ শুনে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। নিঃসন্দেহে এটি একটি বিলাসবহুল দোকান, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- এটি কি তার জাঁকজমকপূর্ণ সাজসজ্জার জন্য গর্জন করছে, নাকি তার সুসংগঠিত পাঠ-সংগ্রহের জন্য? শেষ পর্যন্ত দুই-ই- পাঠক, দর্শনার্থী এবং বইয়ের দোকান- সবাই এই জয়ে অংশীদার।
শেষে ফ্যাশন লেবেল আর কফি সংস্কৃতির কথাও উঠে আসে। যেসব লেবেল পণ্যের নমুনাকে রূপ দেয় লাইফস্টাইল থিয়েটারে, যেসব প্রতিষ্ঠান কফিকে শুধু পানীয় নয়, বরং সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে- তাদের মতোই রেভে’র আকর্ষণও সহজ, মায়াবী। কৌশল মনে হলেও এর উদযাপন শেষ হয় না হ্যাংওভারে- শেষ হয় অফিসের দিনের শেষে, এক নীরব তৃপ্তিতে।
এইসব কারণেই লিভরারিয়া লেলো কেবল একটি বইয়ের দোকান নয়- এটি জীবনের জন্য বুক করা এক অভিজ্ঞতা।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন