তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট (এনআইএমসি) কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন সম্প্রচার পরিবেশের উন্নয়ন সহায়তা প্রকল্পের (SIBE–NIMC Project) আওতায় জুলাই যোদ্ধাদের জন্য পাঁচ দিনব্যাপী ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা’ প্রশিক্ষণ কর্মশালার সমাপনী ও সনদ বিতরণ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শনিবার (৭ ডিসেম্বর) ঢাকার দারুস সালাম ইনস্টিটিউট ভবনে এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। প্রশিক্ষণটি ০২ থেকে ০৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলেছে, যেখানে ১৯ জন তরুণ জুলাই যোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব মুহম্মদ হিরুজ্জামান এনডিসি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন: বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহম্মদ আব্দুল্লাহ। বক্তব্য রাখেন SIBE–NIMC প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক এবং কোর্স পরিচালক সুমনা পারভীন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রশিক্ষণার্থী জুলাই যোদ্ধা ইসরাত জাহান তুশী। অতিথিবৃন্দ ও ফ্যাকাল্টির সদস্যরাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
সভাপতির বক্তব্যে মহাপরিচালক বলেন, ‘আজকের অনুষ্ঠান আমাদের বীর যোদ্ধাদের নিয়ে। সত্যিকার অর্থে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি। আমাদের বীর যোদ্ধাদের কারণেই আজ আমরা এখানে বসে কথা বলতে পারছি। আপনাদের ঋণ শোধ করার মতো নয়। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করা, গণতন্ত্র ও মুক্তির স্বাদ এনে দেওয়ার যে সংগ্রাম আপনারা করেছেন, তা খুব কম মানুষের পক্ষে সম্ভব।’
‘আমাদের রাষ্ট্রে এখনো অনেক কাজ বাকি। বিশেষ করে দুর্নীতির কারণে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। সেখান থেকে দেশকে মুক্ত না করতে পারলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। পাত্রে যদি ছিদ্র থাকে, তবে কিছুই থাকবে না। এই কাজ তরুণরাই পারে, আমরা পারিনি। তরুণরা মাঠে নেমে প্রমাণ করেছে, যত শক্তিশালী বাধাই হোক, সাহস ও প্রতিজ্ঞায় জয় করা যায়। এখন দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আপনাদের।’
‘আপনাদের সামনে বিশাল ভবিষ্যৎ। দুর্নীতিমুক্ত, জঞ্জালমুক্ত, ইতিবাচক বাংলাদেশ গঠনের দায়িত্ব আপনাদের। জাতি আপনাদের ভুলবে না। আমরা আপনাদের কাছে চিরঋণী। চেষ্টা করব, যতটুকু পারি, সেই ঋণ পরিশোধ করতে।’
বিশেষ অতিথি এম. আবদুল্লাহ বলেন, ‘জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট যে উদ্যোগ নিয়েছে, বিশেষ করে মাননীয় তথ্য উপদেষ্টার আগ্রহ ও নির্দেশনায় এই প্রশিক্ষণ অত্যন্ত সময়োপযোগী। এটি দ্বিতীয় পর্ব। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে অবদান রাখার যে আকাঙ্ক্ষা দেখেছি, তা আমাকে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আশাবাদী করেছে।’
‘সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম নিয়ে হতাশার অনেক জায়গা আছে। সেখানে যারা বুক চিতিয়ে, বুক টান করে দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, দেশকে ফ্যাসিস্টমুক্ত করার জন্য রাস্তায় নামতে পারে, গুলি বুকে নিতে পারে, তাদের এই পেশায় আসার আগ্রহ নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক।’
‘আমি প্রত্যাশা করি, তাদের প্রত্যেকের আগ্রহ পূরণ হবে। আগামী দিনে যেসব সহযোগিতা তারা আশা করছে, আমরা যে যেখানে আছি, নিজেদের অবস্থান থেকে সেই সহযোগিতা করাই আমাদের কর্তব্য।’
‘আজ আমরা যে এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, এ সুযোগ করে দিয়েছেন তারাই। তারা রক্ত দিয়েছে, অঙ্গ হারিয়েছে, অসংখ্য শহীদের জীবনের বিনিময়ে আমরা আজ এখানে দাঁড়াতে পারছি। এই দায়বদ্ধতা ভুলে গেলে তা জাতির জন্য দুঃখজনক হবে, আর আমাদের জন্য হবে এক ধরনের নিমকহারামি।’
প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক বলেন, ‘জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট গণমানুষের কল্যাণে দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদ তৈরি করে, যারা গণমাধ্যম শিল্পে কাজ করতে পারে। এই আয়োজন তারই ধারাবাহিকতা। উপদেষ্টা মহোদয়ের বিশেষ আগ্রহে এই প্রশিক্ষণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ডিজি মহোদয় আন্তরিকতার সঙ্গে প্রথম কোর্স সম্পন্ন করেছেন, এটি দ্বিতীয় কোর্স। স্যারকে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি উদ্যোগ না নিলে হয়তো ১৫-২০ দিন বা এক মাস পরে এই আয়োজন হতো। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর মেহেরবানিতে তা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।’
‘জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট মেধাকে লালন করে। আমরা বিশ্বাস করি, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই প্রতিভা আছে, তবে তার বিকাশের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ। কেউ পরিবেশ পায়, কেউ পায় না। আমরা চাই, ইনস্টিটিউট আপনাদের সেই পরিবেশ দিক। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।’
প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, ‘আপনারা অনলাইন পোর্টালে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে অনলাইন পোর্টালের নিয়ম-কানুন, প্রক্রিয়া ও প্রযুক্তিগত বিষয়ে আয়োজন করেছি। সম্পদ ব্যক্তিরা আমাদের সহযোগিতা করেছেন, এবং সম্পদ ব্যক্তি নির্বাচনে আবদুল্লাহ স্যার সহায়তা করেছেন।’
‘এটি একটি টিমওয়ার্ক। একটি প্রতিষ্ঠানে বহু অদৃশ্য মানুষ পর্দার আড়ালে কাজ করেন। আন্তরিকতা ছাড়া কাজ হয় না। ইনস্টিটিউটের কর্মীরা আন্তরিকভাবে আপনাদের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’
‘উপদেষ্টা বলেছেন, নতুন ব্লাড আসবে, গণমাধ্যম খাতে যে ব্যর্থতা হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠবে। আপনারাই সেই অগ্রসেনানী। অনেকেই বলেছেন, আগে জীবন যেভাবে কেটেছে, এখন কিছু করতে চান। আল্লাহ আপনাদের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবেন। জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট সবসময় আপনাদের পাশে থাকবে। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের প্রত্যাশা পূরণে একটি ভূমিকা রাখতে।’
প্রশিক্ষণ চলাকালীন অংশগ্রহণকারীরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নীতি, পদ্ধতি, নৈতিকতা, তথ্য যাচাই, উৎস সুরক্ষা, সাক্ষাৎকার কৌশল, ডেটা সাংবাদিকতা, ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিং ও প্রামাণ্যচিত্র সাংবাদিকতা বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেন।
প্রশিক্ষণার্থী আবু হানিফ বলেন, ‘অনুসন্ধানী বিষয়টি খুবই জটিল। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হওয়ার পর আমাদের কাছে তা আর জটিল মনে হয়নি। এই প্রশিক্ষণও বিষয়টি সহজ করেছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, আমি এই পেশা শুরু করতে চাই।’ তিনি সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
প্রকল্পের আওতায় কোরিয়া সরকারের অনুদানে আধুনিক টিভি স্টুডিও, MAM সিস্টেম ও শুটিং ভ্যান সরবরাহ করা হয়েছে, যা প্রশিক্ষণকে আরও প্রযুক্তিনির্ভর ও গতিশীল করবে।
উল্লেখ্য, Support the Improvement of the Broadcasting Environment for NIMC (SIBE–NIMC) প্রকল্পের অধীনে ইতোমধ্যে ১৫টি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ৩৩০-এর বেশি সাংবাদিক ও মিডিয়া পেশাজীবী প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।
সমাপনী দিনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সনদপত্র বিতরণ করা হয়।

