আজ ৯ ডিসেম্বর, বাঙালি নারী জাগরণের পথিকৃত ও আলোকবর্তিকা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ও মৃত্যুদিন। তার স্মৃতি, কর্ম, সাহিত্যকীর্তি এবং নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশে সরকারি উদ্যোগে পালিত হচ্ছে বেগম রোকেয়া দিবস। নারী উন্নয়ন ও সমাজ পরিবর্তনে তার অগ্রণী ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দেশজুড়ে আয়োজন করা হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি।
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। কুসংস্কার আর রক্ষণশীলতার বেড়াজালে বন্দি সমাজে যখন নারীর শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না, তখন শেখার অদম্য ইচ্ছায় তিনি পরিবারের অজান্তেই বড় ভাইয়ের কাছ থেকে উর্দু, বাংলা, আরবি ও ফারসি শিখে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন।
ঠিক একই দিনে, ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর, ৫২ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তাই দিনটি তার জন্ম ও মৃত্যুদিন হিসেবে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
১৮৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুরে সমাজসচেতন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। প্রগতিশীল মতাদর্শের অধিকারী স্বামীর উৎসাহে রোকেয়া উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান এবং সমাজে নারীর অধিকার নিয়ে আরও দৃঢ়ভাবে কাজ শুরু করেন।
স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি তার সম্পত্তি দিয়ে নারীদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯০৯ সালে মাত্র পাঁচ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের, যা পরবর্তীতে নারী জাগরণের অন্যতম শক্তিশালী কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো নারীর মুক্তি, শিক্ষার বিস্তার এবং আত্মমর্যাদা গঠনে অসামান্য অবদান রাখে।
বেগম রোকেয়ার সাহিত্যকর্ম শুধু সাহিত্য আনন্দই দেয়নি, ছিল সংগ্রাম, প্রতিবাদ এবং মুক্তির ঘোষণা। তার বিখ্যাত রচনা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ একটি কল্পলোক যেখানে নারী নেতৃত্ব দেয়, আর পুরুষ থাকে আড়ালে নারীর সমানাধিকারের শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে বিশ্বজুড়ে আলোচিত। ‘অবরোধ-বাসিনী’, ‘পদ্মরাগ’ ও ‘মতিচূর’-এ তিনি তুলে ধরেছেন নারীর শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, সমাজে তাদের অবস্থান এবং প্রতিনিয়ত চলা সংগ্রামের কাহিনি।
তিনি বলতেন, নারীরাও মানুষ, তারা স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার রাখে। এই দৃঢ় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে রোকেয়া আজীবন লড়ে গেছেন নারীর স্বাধীনতা, সম্মান ও অধিকারের জন্য। তার সংগ্রামেই আবদ্ধ, অবরুদ্ধ নারীরা ধীরে ধীরে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে।
তার উদ্যোগ ও আন্দোলনে বাংলার নারী সমাজে আলো ছড়াতে থাকে জাগরণের শিখা যা আজ বিভিন্ন সেক্টরে নারীর সাফল্যের ভিত্তি।
বেগম রোকেয়ার স্মরণে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করে। সমাজ উন্নয়ন, শিক্ষা, নারী অধিকার, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নারীদের অসামান্য অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে এই পদক হয়ে উঠেছে দেশের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্মান।
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার জরিপে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে স্থান পান রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তার লেখনী, চিন্তা, প্রগতিশীল দর্শন ও সাহসিকতা তাকে শুধু বাংলার নয়, দক্ষিণ এশিয়ার নারী আন্দোলনেরও এক অনন্য প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
আজ বাংলাদেশের সরকার পরিচালনা থেকে শুরু করে শিক্ষা, প্রশাসন, চিকিৎসা, ক্রীড়া, প্রযুক্তি, ব্যবসা, শিল্পকলাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর সাফল্যের যাত্রা বেগম রোকেয়ার দেখানো পথেরই ধারাবাহিকতা। কুসংস্কারমুক্ত, অধিকার-সচেতন ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে তার অবদান অমলিন।
নারী সমাজের উন্নয়ন ও অধিকারের জন্য আজীবন যিনি সংগ্রাম করেছেন, যার লেখনী ও আন্দোলনে বদলে গেছে বাঙালি সমাজ, সেই বেগম রোকেয়া আজও নারী জাগরণের অনুপ্রেরণা।
তার জন্ম-মৃত্যুদিনে সারা দেশ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে এই মহীয়সী নারীকে, যিনি পথ দেখিয়েছেন আলোর নারীর মুক্তি, শিক্ষা ও সমতার।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন