চলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় ১৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পাসের হার দেখা গেছে, সারা দেশে মাত্র ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।
নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফল করেছে রাজশাহী বোর্ড, পাসের হার ৭৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। সবচেয়ে কম পাসের হার বরিশাল বোর্ডে, মাত্র ৫৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আর ঢাকা বোর্ডে পাস করেছে ৬৭ দশমিক ৫১ শতাংশ শিক্ষার্থী।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৬৮ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে ৭৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) ফল প্রকাশের পর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল জিপিএ স্কোর কারচুপি নয়, বরং সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা।’
এদিকে সিলেট বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী জানান, গত বছরের জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি ব্যাহত হয়, যার প্রভাব পড়েছে ফলাফলে।
বরিশাল বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউনুস আলী সিদ্দিকী বলেন, এ বছর রেকর্ড-নিম্ন এসএসসি পাসের হারকে দুর্যোগ হিসেবে দেখা উচিত নয়।
‘যারা মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করেছে এবং গুরুত্ব সহকারে পরীক্ষা দিয়েছে, তারাই ভালো ফল করেছে’ —এমনটাই জানিয়েছেন তিনি। বলেন, এই বছর পরীক্ষার পরিবেশ ছিল কঠোর এবং মূল্যায়ন হয়েছে সম্পূর্ণ সঠিকভাবে, যার ফলে এমন ফলাফল এসেছে।
তিনি জানান, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী নকলমুক্ত পরীক্ষা নিশ্চিত করতে বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলার ডিসি (জেলা প্রশাসক) সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। ফলে গ্রামাঞ্চলেও পরীক্ষা হয়েছে সৎ ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে।
সিদ্দিকী বলেন, ‘এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে শুধু পরীক্ষায় বসলেই পাস করা সম্ভব নয়, বরং পড়াশোনা না করলে ফল ভালো হবে না।’
তিনি আরও যোগ করেন, আগে হয়তো নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয়তা ছিল, কিন্তু এবার উত্তরপত্র যাচাই হয়েছে পুরোপুরি যোগ্যতার ভিত্তিতে। পরীক্ষকদের স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল, ‘শিক্ষার্থীরা যতটুকু প্রাপ্য, কেবল সেটুকুই নম্বর দিতে হবে’। আর তারা ঠিক সেটাই করেছেন।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ মনে করেন, এসএসসি পরীক্ষার পাসের হার কমে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। যেমন- শিক্ষার্থীদের দুর্বল প্রস্তুতি, সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন, কিংবা আর্থ-সামাজিক সমস্যা।
তবে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, মূল কারণ সম্ভবত মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সরকারের নীতিগত পরিবর্তন।
তিনি বলেন, ‘পূর্ববর্তী সরকার পাসের হার বাড়িয়ে জনসন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করেছিল। তখন মনে করা হতো, বেশি পাস মানেই ভালো শিক্ষা।’ সে সময় পরীক্ষকদের ইঙ্গিত দেওয়া হতো যেন উদারভাবে নম্বর দেওয়া হয়, প্রশ্নের উত্তর যেমনই হোক না কেন।
আইইআর অধ্যাপক আরও বলেন, গত ১৫ বছর ধরে রাজনৈতিক কারণে অযথা বেশি নম্বর দেওয়া অনেকটা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। এর পরিণতি দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায়।
তিনি বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করে। অথচ এদের অনেকে এসএসসি-এইচএসসিতে ‘এ+’ বা ‘এ’ পেয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে তারা সেই মানের ছাত্র ছিল না।”
বর্তমান সরকার মূল্যায়ন প্রক্রিয়া কঠোর করে সেই পুরোনো উদার নম্বর দেওয়ার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে বলে মনে করেন অধ্যাপক রশিদ।
আইইআর-এর আরেক অধ্যাপক এসএম হাফিজুর রহমান মনে করেন, এবারের এসএসসি ফলাফল শিক্ষার্থীদের প্রকৃত দক্ষতাকেই বেশি সঠিকভাবে তুলে ধরেছে।
তিনি বলেন, ‘এবার কাউকে গ্রেস মার্কস (অতিরিক্ত নম্বর) দেওয়া হয়নি, আর নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রেও আগের মতো শিথিলতা রাখা হয়নি।’ তার মতে, এই পরিবর্তনই পাসের হার কমে যাওয়ার প্রধান কারণ।
অধ্যাপক হাফিজুর রহমান এমন স্কুলগুলোর বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন, যেখানে একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘যেসব স্কুলে ২০ শতাংশের কম পাসের হার, সেগুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার। এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ স্কুলগুলোর জন্য আলাদা উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া উচিত।’
তিনি আরও বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো অনেক বেশি কেন্দ্রীয় নীতির ওপর নির্ভরশীল। তার মতে, একই নিয়ম সবার ওপর চাপিয়ে না দিয়ে, স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী অঞ্চলভিত্তিক শিক্ষানীতি নেওয়া এখন সময়ের দাবি।