রাশিয়া যখন ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করে তখন দেখা যায় চীন, উত্তর কোরিয়া আর ইরান বিভিন্নভাবে তাকে সাহায্য করছে। এই ঘটনার পর কিছু মার্কিন ও ব্রিটিশ কর্মকর্তা বলেছিলেন, এই চার দেশ (রাশিয়া, চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া) যেন একটি নতুন ‘অক্ষশক্তি’ তৈরি করেছে, যারা একসঙ্গে আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে।
এই চার দেশের মধ্যে কিছু মিল আছে—তারা সবাই কর্তৃত্ববাদী, পশ্চিমা বিরোধী এবং আমেরিকার প্রতি ক্ষুব্ধ। কিন্তু যখন যুদ্ধের বাস্তবতা সামনে আসে, তখন এই ঐক্য প্রশ্নের মুখে পড়ে। যেমন, রাশিয়া ইরানের কাছ থেকে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে আর চীন রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনেছে; এগুলো রাশিয়ার জন্য কাজে লেগেছে ঠিকই, কিন্তু এগুলোর পেছনে ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকলেও ছিল না আদর্শগত বন্ধুত্ব।
সবচেয়ে বড় বিষয় যখন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ সংঘঠিত হলো কিংবা আমেরিকা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাল তখন তিন দেশের কেউই তেহরানকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেনি। পারমাণবিক শক্তিধর রাশিয়া ও চীন কথায় ওয়াশিংটনের সমালোচনা করেছে, কিন্তু বাস্তবে কিছুই করেনি।
রাশিয়াবিষয়ক গবেষক ও ইউরেশিয়া সেন্টারের পরিচালক আলেকজান্ডার গাবুয়েভ বলেন, ‘‘এই যুদ্ধ দেখিয়ে দিয়েছে চীন ও রাশিয়া কেউই ইরানকে বাঁচাতে আসেনি। এতে বোঝা যায়, ‘অক্ষশক্তি’ বলে যে ধারণা তোলা হচ্ছে তা আসলে খুবই সীমিত।”
গাবুয়েভ আরও বলেন, ‘এই চার দেশ আসলে খুবই স্বার্থপর। তারা নিজেদের বাইরে অন্য কারও যুদ্ধে জড়াতে চায় না। তাদের যুদ্ধগুলোও আলাদা ধরনের অর্থাৎ একেকটা একেক রকম পরিস্থিতিতে হচ্ছে। এদের মধ্যে পশ্চিমাদের মতো কোনো অভিন্ন মূল্যবোধ, কাঠামো বা শক্ত প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই।’
চীন, রাশিয়া, ইরান এবং উত্তর কোরিয়ার সরকার ‘স্বৈরাচারী’। চার দেশের সরকার ব্যবস্থাতেই এটি বিদ্যমান। তারা সবাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শত্রু মনে করে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই তাদের দুর্বল করার চেষ্টা করেছে এবং তাদের শাসনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
তবে এসব দেশের মধ্যে কিছু কৌশলগত যোগাযোগ আছে। তারা পরস্পরের সঙ্গে বাণিজ্য করে, অস্ত্র ও প্রযুক্তি ভাগাভাগি করে এবং পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলোর প্রভাব কমাতে একে অপরকে সহায়তা করে।
মার্কিন ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বই লিখেছেন মাইকেল কিমগেজ। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, এ দেশগুলো কিছুটা যোগাযোগ রাখে, আর তারা সবাই পশ্চিমাদের নিয়ে একইরকম হতাশা পোষণ করে। কিন্তু এটাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বা অর্থবহ সম্পর্ক বলা যাবে না।’
দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে একটি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে। রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করার পাশাপাশি উত্তর কোরিয়া ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে রাশিয়ানদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য ১৪ হাজারের বেশি সৈন্য পাঠিয়েছে। তাদের সম্পর্কের পেছনে রয়েছে কমিউনিজমের প্রভাব। তাছাড়া, ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সালের যুদ্ধে উত্তর কোরিয়া আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়েছিল, আর মাও সেতুং-এর চীন সরাসরি তাকে সহায়তা করেছিল। সেই সময় থেকেই মার্কিন-বিরোধী অবস্থানে তাদের এক ধরনের পুরোনো সংযোগ তৈরি হয়।
চীন ও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পেছনেও রয়েছে ঐতিহাসিক কারণ। দুই দেশের এই বন্ধনের শিকড় একযুগ পুরোনো কমিউনিস্ট অতীতে এবং কোরিয়ান যুদ্ধের সময়কার অভিজ্ঞতায় নিহিত, যেখানে তারা একসঙ্গে আমেরিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। আজও এই সম্পর্ক বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হিসেবে বিবেচিত হয়।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বছরের পর বছর একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার হামলার ঠিক আগে তারা ঘোষণা দেন যে, চীন-রাশিয়ার অংশীদারিত্ব ‘সীমাহীন’।
তবে, চীন এখনো ট্রাম্প-পূর্ব যুগে প্রতিষ্ঠিত কিছু আন্তর্জাতিক নিয়মকে মূল্য দেয়, যেগুলো পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো প্রচার করেছে। সেই কারণেই যুদ্ধ চলাকালে রাশিয়াকে সরাসরি বড় আকারে অস্ত্র দেয়নি। কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, চীন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে এবং রাশিয়ান তেলের অন্যতম প্রধান ক্রেতা হিসেবেও রয়ে গেছে।
রাশিয়া ও ইরানের সম্পর্ক অতীতে কখনো খুব ঘনিষ্ঠ ছিল না। এই দূরত্বের একটি বড় কারণ ধর্ম। ইরান একটি ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে ইসলামই শাসনের মূলভিত্তি। অন্যদিকে চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া এই তিন দেশই ধর্মনিরপেক্ষ এবং ইসলামি শাসনব্যবস্থার প্রতি সন্দেহপ্রবণ। চীন তো বিশেষ করে ‘ইসলামি মৌলবাদের’ প্রসার নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এমনকি চীনের পশ্চিমাঞ্চলে মুসলিম উইঘুর ও কাজাখদের ধর্মীয় রীতিনীতিও কঠোরভাবে দমন করেছেন।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ সের্গেই রাডচেঙ্কো বলেন, “এই চার দেশের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো গভীর মূল্যবোধগত ঐক্য নেই। ‘বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থা’ নিয়ে তাদের কিছুটা অস্পষ্ট ধারণা থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবে তাদের মধ্যে অনেক দ্বন্দ্ব রয়েছে। পুতিন নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু দেখেন না। ইরানের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখার জন্য তিনি কখনোই ‘ইসরায়েল’ বা আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে রাজি হবেন না।”
রাডচেঙ্কো বলেন, ‘পুতিন কৌশলী, সুযোগসন্ধানী। যদি তার স্বার্থে ইরানকে বিপদে ফেলতে হয়, তাতেও সে রাজি। এবং তেহরানও এটা ভালো করেই বোঝে।’
গত ১৪ জুন পুতিন ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরান-‘ইসরায়েল’ যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেন এবং পুতিন মধ্যস্থতা করতে চাওয়ার প্রস্তাব দেন। পরে তিনি প্রকাশ্যে জানান, রাশিয়া ইতোমধ্যে ইরানে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করেছে এবং আরও দুটি তৈরিতে সহায়তা করছে।
ভ্লাদিমির পুতিন ইরানের সঙ্গে অংশীদারিত্বের কথা বললেও যুদ্ধের সময় ইরানকে সরাসরি সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেননি। তিনি বলেন, “আমরা কাউকে কোনো কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না। শুধু বলছি, সংকট থেকে বেরিয়ে আসার কী উপায় হতে পারে। তবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সংশ্লিষ্ট দেশের নেতাদের, বিশেষ করে ইরান ও ‘ইসরায়েল’কে।”
মার্কিন হামলার একদিন পর ২৩ জুন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি মস্কোয় পুতিনের সঙ্গে দেখা করেন। তবে রাশিয়ার পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়, তা ছিল কেবল সাধারণ কূটনৈতিক সমর্থনের ভাষা অর্থাৎ কোনো স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি বা সহায়তার কথা বলা হয়নি। সেই দিনই ইরান প্রতীকীভাবে কাতারে একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে এবং তারপর ‘ইসরায়েল’ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়।
এই পুরো ঘটনার সময় চীনও একপাশে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, ‘সব পক্ষের উচিত উত্তেজনা কমানোর জন্য কাজ করা’। আর যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানে হামলার নির্দেশ দেন, তখন চীন এর তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সনদ লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে।
কিন্তু রাশিয়ার মতো চীনও ইরানকে বাস্তবিক (বস্তুগত) সহায়তা পাঠায়নি। চীন মাঝেমধ্যে এই অঞ্চলের সংঘাত নিয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিলেও বাস্তবে চেষ্টা করে সবার সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখতে। কারণ চীন শুধু ইরানের সঙ্গে নয়, ইরানের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ইরানের মতো সৌদি আরবও চীনের জন্য একটি বড় তেল সরবরাহকারী দেশ।
যুদ্ধ যদি আরও ছড়িয়ে পড়ে এবং বড় ধরনের আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নেয়, তাহলে চীনের জন্য বড় বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ এতে ওই অঞ্চল থেকে চীনের তেল আমদানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই চীন সংঘাত বাড়ানোর বদলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতেই বেশি মনোযোগী।
এই শান্তিপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার ইচ্ছা ২০২৩ সালের মার্চে স্পষ্ট হয়, যখন চীন ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে বড় ভূমিকা রাখে। সেই সুযোগে চীন ইরানের মিত্র সিরিয়ার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে, তখন দেশটিতে শাসন করছিলেন বাশার আল-আসাদ।
নেপলস বিশ্ববিদ্যালয়ের ল'ওরিয়েন্টালের অধ্যাপক এনরিকো ফারদেলা বলেন, ‘সেই সময়টা ছিল চীনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাবের চূড়ান্ত সময়।’ তবে এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। ইরান যুদ্ধের কারণে দুর্বল, আর সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের হাতে আসাদ ক্ষমতা হারিয়েছেন। তাই এখন চীন খুব সাবধানে চলছে—দেখছে কে এই সংঘাত-পরবর্তী অঞ্চলে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
তিনি আরও বলেন, “যদিও বেইজিং যুদ্ধবিরতি ও স্থিতিশীলতা চায়, কিন্তু এখন তারা অনেকটা ‘অপেক্ষা করো ও দেখো’ নীতিতে চলছে। সিরিয়ায় যেমন করেছিল, এখনো তারা ধীরে ধীরে নিজেদের প্রভাব ফিরিয়ে আনার পথ খুঁজছে।”
অন্যদিকে, ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের গবেষক ইউন সান মনে করেন, চীন, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে ‘অক্ষশক্তির’ ধারণাটি এখনো প্রযোজ্য। যদিও তাদের মধ্যে কোনো পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি নেই, তবুও তারা সবাই এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করে—যেটা হলো ‘মার্কিন-বিরোধী, পশ্চিমা প্রভাব-বিরোধী এবং উদার গণতন্ত্রের বিরোধী’ মনোভাব।
তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, তারা একে অপরের হয়ে যুদ্ধ করে না ঠিকই, কিন্তু তাতে তাদের একসঙ্গে কাজ করার ক্ষমতা বা অবস্থান কমে যায় না। চীন ইরানকে পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি দিয়েছে, রাশিয়ার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আর্থিকভাবে সাহায্য করেছে, আর উত্তর কোরিয়াকে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। এটা একধরনের জোটই।’
তবে চীনের ইরানকে সমর্থনেরও একটা সীমা আছে বলে মনে করেন গবেষক ইউন সান। তিনি বলেন, চীনা কর্মকর্তারা ইরানের ধর্মীয় নেতৃত্বের উপর খুব একটা ভরসা করেন না। তাদের মতে, ইরান অনেক সময় ‘অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ, সুবিধাবাদী, সিদ্ধান্তহীন’ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও অনেকটা দোদুল্যমান।
চীনের কর্মকর্তারা এটাও জানেন যে, ইরান অনেকটা উত্তর কোরিয়ার মতো একটি বিচ্ছিন্ন দেশ, যার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দুর্বল। আর তাই মাঝেমধ্যে দূরত্ব তৈরি হলেও ইরানের জন্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
২৬ জুন যখন ইরান ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়, তখন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজিজ নাসিরজাদেহ বিদেশ সফরে যান। তিনি চীনের কিংদাও শহরে যান, যেখানে রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্বে গঠিত ইউরেশিয়ান নিরাপত্তা গোষ্ঠী সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।