ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০২৫

বিশ্লেষণ

ইউক্রেন কি এশিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে?

সি. রাজা মোহন
প্রকাশিত: আগস্ট ২০, ২০২৫, ১০:২৫ পিএম
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি (বামে) এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (ডানে)। ছবি- সংগৃহীত

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেন আক্রমণ করলে তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা সতর্ক করেছিলেন যে, যুদ্ধের ফলাফল এশিয়ার ভবিষ্যতের পূর্বাভাস হতে পারে। তার বার্তা ছিল স্পষ্ট; ইউরোপ যেমন রাশিয়ার সম্প্রসারণবাদী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তেমনি এশিয়া চীনের ক্রমবর্ধমান দৃঢ়তার সামনে পড়তে পারে, যা সংশ্লিষ্ট মহাদেশের জন্য গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

তিন বছর পর কিশিদার সেই সতর্কবার্তা নতুন তাৎপর্য পাচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে অঞ্চল ছাড়তে চাপ দিচ্ছেন, অনিশ্চিত সময়ের শান্তির বিনিময়ে। একই সঙ্গে ইউরোপীয় মিত্রদেরও এই অবস্থানে দাঁড়াতে বলছেন। এশিয়ার দেশগুলোর জন্য ট্রাম্পের এই কূটনীতি বড় প্রশ্ন তুলছে, আমেরিকা কি এখনও ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা গ্যারান্টার হয়ে থাকবে?

২০২২ সালের জুনে শাংরি-লা সংলাপে কিশিদা বলেছিলেন, ‘আজকের ইউক্রেন আগামীকাল পূর্ব এশিয়া হতে পারে’। এটি জাপানের দীর্ঘদিনের অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, যেখানে টোকিও নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে সমর্থন এবং ‘মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক’ ধারণাকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে আসছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে-ও বছরের পর বছর ধরে চীনের উত্থানের প্রতিক্রিয়ায় এ ধরনের কাঠামোর পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড়ে সক্রিয় ছিলেন।

জাপান শুধু পশ্চিমা প্রতিরোধকেই সমর্থন করেনি, বরং সক্রিয় অংশীদার হয়েছে। ওয়াশিংটনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে টোকিও অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ২০২২ সালে ন্যাটোর মাদ্রিদ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়। এই তথাকথিত এশিয়া-প্যাসিফিক ফোর (এপি৪)-এর অংশ হিসেবে ট্রান্স-আটলান্টিক নিরাপত্তা ও এশিয়ার উদ্বেগকে একত্রিত করার প্রচেষ্টা করা হয়। কিন্তু এখন ট্রাম্পের উল্টো নীতি সেই সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

এশিয়ার বহু দেশ ভিন্ন পথ নিয়েছে। চীন, ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ দেশ রাশিয়ার হামলার সরাসরি নিন্দা করা থেকে বিরত থাকে। ওয়াশিংটনের অবস্থান পরিবর্তন এবং মস্কোর সঙ্গে সমঝোতার ফলে এসব দেশ নিজেদের অবস্থানকে আরও সঠিক প্রমাণিত বলে মনে করছে। 

ইতোমধ্যে এশিয়ার নিজস্ব নিরাপত্তা সংকট আরও প্রকট হয়েছে। চীনের এই অঞ্চলে শক্তি ইউরোপে রাশিয়ার চেয়ে অনেক বেশি। রাশিয়া ইউরোপের প্রান্তে হলেও চীন এশিয়ার কেন্দ্রে, যেখানে তার দীর্ঘ স্থলসীমান্ত ও কৌশলগত জলসীমা রয়েছে। ভুটান ও ভারতের সঙ্গে বিরোধ চলমান। প্রশ্ন উঠছে, চীন কি হিমালয়ে আরও আক্রমণাত্মক হবে?

সমুদ্রসীমা আরও তীব্র উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে কয়েক দশকের বিরোধ ইউক্রেনে শক্তি প্রয়োগের নজির দ্বারা আরও জটিল হতে পারে। যদি রাশিয়া পরিণতি ছাড়া ভূখণ্ড দখল করতে পারে, তবে চীনও একই পথে হাঁটতে পারে, তাইওয়ান সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে।

রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা চীনের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারে, তবে ট্রাম্পের কৌশল বেইজিংয়ের জন্যও চিন্তার কারণ। তিনি রাশিয়া ও চীনকে ‘প্রাকৃতিক শত্রু’ বলেছেন এবং মস্কোকে বেইজিং থেকে দূরে সরাতে চান। যদিও পুতিন ও শি জিনপিংয়ের অংশীদারিত্ব ভাঙার সম্ভাবনা কম, তবে ট্রাম্প মস্কো ও ওয়াশিংটনকে বেইজিংয়ের সঙ্গে আলাদা শর্তে মোকাবিলা করার সুযোগ করে দিতে পারেন।

ভারতের জন্যও এই কূটনীতি উদ্বেগজনক। দীর্ঘদিন ধরে নয়াদিল্লি বলে আসছে পশ্চিমা চাপ রাশিয়াকে চীনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু মার্কিন-রাশিয়া সমঝোতা ভারতের জন্য কৌশলগত স্বস্তি আনে না। ট্রাম্প একইসঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে যেমন ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন, শি’কে নিয়েও উষ্ণতা দেখাচ্ছেন, যা এশীয় মিত্রদের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।

ট্রাম্পের এই নীতি এশিয়ার জন্য বড় শিক্ষা। ইউরোপে তিনি মিত্রদের বাদ দিয়ে ইউক্রেনের ভাগ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। এশিয়ায় যেখানে নিরাপত্তা দ্বিপাক্ষিক জোটের ওপর নির্ভর করে, সেখানে প্রভাব আরও বড় হবে। ভুল গণনার আশঙ্কা প্রবল। ট্রাম্প চীনের শক্তিকে খাটো করে দেখছেন, আর ওয়াশিংটনের একতরফা প্রভাবকে অতিরিক্ত মূল্য দিচ্ছেন।

পরিশেষে, ট্রাম্পের ইউক্রেন কৌশল তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ দৃষ্টিভঙ্গিকে স্পষ্ট করে। তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম মাসগুলোতে এশিয়া বাণিজ্যে এর প্রভাব দেখেছে, এখন নিরাপত্তায়ও তার ছায়া পড়ছে। ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিনের সঙ্গে তার কূটনৈতিক তৎপরতা এখন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে স্থিতিশীল সম্পর্ক গড়ার ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যদি সংঘর্ষ তৈরি হয়, তবে তিনি মিত্রদের নিরাপত্তা উদ্বেগকেও বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।

কিশিদার সতর্কবার্তা নতুন অর্থ পাচ্ছে, অর্থাৎ এশিয়ার মিত্রদের হয়তো এমন এক ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে হবে, যেখানে মার্কিন প্রতিশ্রুতি অনিশ্চিত ও ক্ষণস্থায়ী, আর নিরাপত্তার বোঝা তাদের নিজেদের কাঁধেই আরও বেশি পড়বে।


লেখক: ফরেন পলিসির কলামিস্ট ও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডের প্রাক্তন সদস্য।