দীর্ঘদিন ধরে দখল হয়ে থাকা জমি উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এই অভিযান চালাতে গিয়ে অবৈধভাবে নির্মিত মসজিদ-মন্দিরসহ বহু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। রাজধানীর খিলক্ষেতে রেলের এমনই কিছু জমি ছিল। সেখান থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানের সময় একটি টিনশেডের দুর্গা মন্দির সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
এটাই এখন গুজবসৃষ্ট ‘সাম্প্রদায়িক’ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। দুঃখজনক হলো- এই দেশে এখন কথায় কথায় অনাকাঙ্খিত সাম্প্রদায়িক বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়, বিশেষ করে গত এক বছরে এই প্রবণতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে- কথায় কথায় ভারতের বিবৃতি। দেশটির অবাঞ্ছিত দাদাগিরিতে আমরা ভীষণভাবে বিরক্ত।
অস্থায়ীভাবে তৈরি করা খিলক্ষেতের মন্দির সরিয়ে নেয়ার জন্য রেলওয়ে আগেই নোটিশ দিয়েছিল। কিন্তু এর বিপরীতে কিছু মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যম শুরু করেছে পরিকল্পিত অপপ্রচার। বিশেষ করে ভারতের কিছু উগ্রপন্থি একাউন্ট থেকে ছড়ানো হচ্ছে ভুয়া ছবি, বিভ্রান্তিকর ভিডিও যে২গুলোতে বলা হচ্ছে- ‘হিন্দুদের উপর নির্যাতন’ এর গল্প।
প্রশ্ন হচ্ছে- কেন এই গুজব?
পতিত আওয়ামী লীগ বহু বছর ধরেই রাজনৈতিক আশ্রয় খোঁজে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ভেতরে। ভারতে রয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী একটা গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী ও তাদের মিডিয়া চায় বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে দেখতে চায়, বিশ্ববাসীকে সেভাবেই দেখাতে চায়।
RAW এবং কিছু আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা উস্কে দিতে আগ্রহী। তবে তথ্য বলছে ভিন্ন কথা:
বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যে ‘ব্যাপক নির্যাতনের’ গুজব ছড়ানো হচ্ছে, তা ভুয়া। বেশিরভাগ ভুয়া পোস্ট এসেছে ভারত থেকে —BBC Verify, Fact Watch, Brandwatch সবাই তা নিশ্চিত করেছে।
লিটন দাসের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, সেটাও ছিল মিথ্যা—সেটা মাশরাফি বিন মর্তুজার বাড়ি, রাজনীতিক টার্গেট ছিল, ধর্মীয় নয়। আগেও দেখা গেছে, ঢাকায় মসজিদ সরানো হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে কিন্তু তখন তো গর্জে ওঠেনি কেউ!
বাংলাদেশ সরকার এরইমধ্যে হটলাইন চালু করেছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলে রক্ষা করছে উপাসনালয়, ঘরবাড়ি, মসজিদ- মন্দির পাহারা দেয়ার ঘটনা সেই প্রমাণ।
বিভ্রান্তিকর গুজবের বিরুদ্ধে থাকুন। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংস করতে চায় যারা, তারা চিহ্নিত শত্রু। এই দেশে হিন্দু-মুসলমান, সব ধর্মের মানুষ একসাথে স্বাধীনতা এনেছে, একসাথেই এগিয়ে যাবে- এটাই স্বাভাবিক। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ভিন্ন কোনো চক্রান্ত করে এখানে সুবিদা করতে পারবে না।
রেলের জায়গা উদ্ধার প্রসঙ্গে খিলক্ষেত থানার ওসি মো. কামাল হোসেন বলেন, রেলের জায়গাতে মন্দির ছিল। এতদিন টিনের বেড়া ছিল। গত সোমবার ২৩ জুন মন্দির কর্তৃপক্ষ পাকা দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু করলে স্থানীয়রা বাধা দেয়। এতে উত্তেজনা দেখা দিলে রাত ১০টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
অপসারিত মণ্ডপটি ছিল সম্পূর্ণ অননুমোদিত এবং দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে রেলের জমি দখল করে রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। শুক্রবার ২৭ জুন রাতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকীর পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একথা জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) রেলের উচ্ছেদ অভিযানের অংশ হিসেবে খিলক্ষেত এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। ওই অভিযানে শুরুতে প্রায় ১৫০টি দোকান, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়, কাঁচাবাজারসহ বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা অপসারণের পর অস্থায়ী মন্দিরটি সরানো হয়। মন্দিরে থাকা প্রতিমা যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদার সঙ্গে বালু নদীতে বিসর্জন দেয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পূজার আয়োজকরা গত বছর দুর্গাপূজার সময় রেলের জমিতে অনুমতি ছাড়াই অস্থায়ী পূজা মণ্ডপ নির্মাণ করেন। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এলে পূজা শেষে মণ্ডপ সরিয়ে নেয়ার শর্তে সাময়িকভাবে পূজা চালানোর অনুমতি দেয়া হয়।
কিন্তু পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পরও আয়োজকরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে মণ্ডপটি সরিয়ে নেননি। বরং সেখানে স্থায়ী মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ নেন। একাধিকবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তারা দখলদারি অব্যাহত রাখে। ফলে জনস্বার্থে এবং সরকারি সম্পত্তি দখলমুক্ত করতে সব আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মণ্ডপটি উচ্ছেদ করা হয়।
রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে কোনো বিভ্রান্তি বা উসকানিমূলক প্রচারণা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা:
ঢাকার খিলক্ষেত এলাকায় রেলের জমিতে অস্থায়ী মণ্ডপ সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে সরকার।
শুক্রবার (২৭ জুন) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যে মন্দির ভাঙার অভিযোগ উঠেছে, সেটি আসলে রেলওয়ের জমিতে পূজার সময় অস্থায়ীভাবে স্থাপন করা মণ্ডপ। এটি পূজা শেষে সরানোর শর্তে অনুমতি দেয়া হলেও আয়োজকরা সরায়নি। বরং সেখানে মহাকালী মূর্তি স্থাপন করে মণ্ডপটি স্থায়ী করার চেষ্টা করা হয়।
এক বিজ্ঞপ্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ২০২৪ সালের দুর্গাপূজার সময় অনুমতি ছাড়া রেলওয়ের জমিতে মণ্ডপ স্থাপন করা হয়। পরে রেলওয়ে শর্তসাপেক্ষে পূজা করতে দেয়, কিন্তু পূজা শেষের পর আয়োজকরা মণ্ডপ সরায়নি। বরং সেখানে কালী মূর্তি স্থাপন করে মণ্ডপ স্থায়ী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা রেলওয়ের সঙ্গে করা সমঝোতা লঙ্ঘন করেছে।
রেলওয়ের দাবি, ঢাকা-টঙ্গী রুটে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ লাইন নির্মাণ প্রকল্পের জন্য রেললাইনের পূর্বের ২০০ ফুট জায়গা খালি করা জরুরি। স্থানীয় দোকান, রাজনৈতিক কার্যালয় এবং অস্থায়ী মণ্ডপসহ সব অবৈধ স্থাপনা সরানোর জন্য একাধিকবার নোটিশ দেয়া হলেও সাড়া মেলেনি।
সবশেষ ২৬ জুন রেলওয়ে শান্তিপূর্ণভাবে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। উচ্ছেদের সময় মণ্ডপের মূর্তি স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে বালু নদীতে সম্মানের সঙ্গে বিসর্জন দেয়া হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, সরকারি জমি পুনরুদ্ধারে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ একটি নিয়মিত প্রশাসনিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বৈধভাবে নির্মিত উপাসনালয় পূর্ণ সুরক্ষা পায়। কিন্তু সরকারি জমি দখল করে কোনো ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণ অনুমোদিত নয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সব সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা ও উপাসনালয় সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ তার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য রক্ষায় কখনো পিছপা হয়নি।
সরকারের এ বক্তব্যকে গ্রহণ না করে শুক্রবার শ্রী শ্রী সার্বজনীন মন্দির ভাঙার অভিযোগে প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে জাতীয় হিন্দু মহাজোট, সম্মিলিত সনাতনী জাগরণী জোট। মহাজোট নেতারা দাবি করেন, ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্র কুমার চৌধুরীর জমিতে রেললাইন নির্মাণ হওয়ায় মন্দির নির্মাণের অধিকার রয়েছে হিন্দুদের।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- ভারতও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। শুক্রবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার মন্দিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে উল্টো অবৈধ জমি ব্যবহারের যুক্তিতে ভাঙার অনুমতি দিয়েছে। আমরা অত্যন্ত হতাশ। লক্ষ্যণীয়, বাংলাদেশে এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে তা সত্য হোক আর মিথ্যা হোক ভারত বিবৃতি দেবে। এটা অনেকটা নিয়মে পরিণত করেছে দিল্লি।
প্রশ্ন হচ্ছে- ভারতে অহরহ সংখ্যালঘুরা নির্যাতন নিপীড়নের শিকার। তাদের ব্যাপারে এতটা উদাসীন কেন বিজেপি সরকার। এরা কথায় কথায় বিবৃতি দেয় কেন? ভারতের এই দাদাগিরি বন্ধ হওয়া জরুরি। আমরা এটা দেখতে চাই না, যেমন চাই না কথায় কথায় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে। এক শ্রেণির মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এগুলো।
লেখক সিনিয়র সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক সিরাজুল ইসলাম