ঢাকা শনিবার, ১৯ জুলাই, ২০২৫

মতামত

ফের ত্রাতার ভূমিকায় সেনাবাহিনী, গোপালগঞ্জে হানাহানির দায় কার?

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান
প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২৫, ০৯:০৭ পিএম
গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশ ঘিরে হামলা ও সংঘর্ষের চিত্র। ছবি- সংগৃহীত

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের হামলা, নাশকতা ও সহিংসতায় প্রাণ ঝরেছে অন্তত চারজনের। আলোচিত এই কর্মসূচির আগের দিন মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বুধবার (১৬ জুলাই) জেলা শহরের পৌরপার্ক এলাকায় আয়োজিত সমাবেশের মঞ্চে হামলা, ভাঙচুরের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হন এনিসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা। পরে সভা শেষে ফেরার পথে এনসিপির গাড়িবহরে দ্বিতীয় দফায় হামলার ঘটনা ঘটে। এক সময় গোপালগঞ্জ পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী বল প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়। যদিও সংঘাত এড়াতে স্থানীয় প্রশাসনের আগাম পদক্ষেপ বা কৌশল নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রথমে ২২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করা হলেও বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউয়ের সময় বাড়ানো হয়। বর্বরোচিত এই হামলার ঘটনাকে মানবাধিকারের ‘লজ্জাজনক লঙ্ঘন’ হিসেবে অভিহিত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফ্যাসিবাদের পুনরাবৃত্তির পথেই পতিত দলটির নেতাকর্মীরা হাঁটছেন বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, অতর্কিত হামলার পর সেদিন ৩টার দিকে জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) কার্যালয়ে আশ্রয় নেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলমসহ দলটির শীর্ষ নেতারা। পরে তারা সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান এপিসিতে করে গোপালগঞ্জ ছাড়েন। সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায় সন্ধ্যায় নিরাপদে খুলনায় পৌঁছান এবং সেখানে সংবাদ সম্মেলন করেন। এনসিপির নেতাদের জীবন রক্ষায় দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীলতা নজির স্থাপন করেছে। সংঘাতের মুহুর্তে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ত্রাতায় ভূমিকায় অবতীর্ণ না হলে প্রাণহানিসহ মহাবিপদ ঘটতে পারত।

এর আগেও সেনাবাহিনী আনসার বিদ্রোহে আনসার সদস্যদের হামলায় আহত এনসিপির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহকে উদ্ধার করে ঢাকা সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। 

যদিও পরবর্তী সময়ে একটি ইস্যুতে হাসনাত আব্দুল্লাহ সেনাপ্রধানকে ইঙ্গিত করে ফেসবুক পোস্টে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। দলটির আরেক নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী হাসনাতের ওই স্ট্যাটাসকে ‘শিষ্টাচারবর্জিত’ উল্লেখ করে বক্তব্য রাখেন। এই বিষয়ে সেনা সদরদপ্তর আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও সুইডেনভিত্তিক অনলাইন নিউজপোর্টাল নেত্র নিউজে সেনাসদরকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলেছিল, ‘‘হাসনাত আবদুল্লাহর পোস্ট ‘সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি বৈ অন্য কিছু নয়।’’

এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে নানা ঘটনা পরিক্রমায় সেনাবাহিনীকে তথা সশস্ত্র বাহিনীকে জড়িয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের কারো কারো একতরফা ও একপক্ষীয় অভিযোগ আর কল্পকাহিনী ফাঁদার তোড়জোড় বাড়বাড়ন্ত হয়ে ওঠেছে। অথচ জুলাই-আগস্টের স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান স্বার্থক উপসংহারে পৌঁছে দিতে লাশের সারিকে আর দীর্ঘ না করে দেশ ও জনগণের স্বার্থে অসীম সাহস ও দূরদৃষ্টিতে কালজয়ী এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। ঐতিহাসিক এক বাঁকবদলে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁনকে সঙ্গে নিয়ে ‘টিম ওয়ার্ক’ এর মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ফয়সালা করেছেন। বিস্মৃতিপ্রবণ বলেই কীনা অনেকেই হয়তো সেটি বেমালুম ভুলে গেছেন।

আওয়ামী লীগের জন্য বিশেষ ও স্পর্শকাতর এলাকা হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের সুলুক সন্ধান শুরু হয়েছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলেও তারা বড়রকমের সহিংসতার মাধ্যমেই নিজেদের অবস্থানকে জানান দিয়েছে। এনসিপির সমাবেশটি পূর্ব ঘোষিত হলেও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগাম যথাযথ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় এবং ব্যাপক জনসমাগম না ঘটলেও এনসিপি সমাবেশ করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় সংঘবদ্ধ হয়েই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাকর্মীরা কয়েক দফা তাদের ওপর হামলার দুঃসাহস দেখিয়েছে। স্থানীয়ভাবে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের কাছ থেকেও এনসিপি কোনোরকম সহযোগিতা পাননি। ফলে সুযোগ বুঝে প্রকাশ্যে সংঘর্ষে নামতে পেরেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। রুদ্ধশ্বাস এই পরিস্থিতির সময়ে এনসিপির অবরুদ্ধ নেতাদের জীবন রক্ষায় অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারাও এগিয়ে আসেননি।

ফলে নিষিদ্ধ দলটির তাণ্ডব-সহিংসতার দায় কোনো পক্ষই এড়াতে পারে না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, গোপালগঞ্জের এই ঘটনা সারা দেশে ঘটতে থাকলে দেশের রাজনীতিতে মারাত্মক অস্থিরতা তৈরি করবে। তাতে পতিত আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। এই ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

গোপালগঞ্জের অনাকাক্সিক্ষত এই পরিস্থিতি এড়াতে কেউ কেউ আগাম বাড়তি সতর্কতার অভাবকেই মোটা দাগে দায়ী করেছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী নিজেও স্বীকার করে বলেছেন, ‘গোপালগঞ্জে বুধবার যে ঘটনা ঘটেছে, সে সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। তবে এত পরিমাণ যে হবে, ওই তথ্য হয়তো ছিল না।’ 

অনেকেই পুরো পরিস্থিতির জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে অভিযোগের তীর ছুড়লেও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া সেটি ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘গোপালগঞ্জে যা ঘটেছে তা দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভালো ভূমিকা পালন করেছে। তারা সফলভাবে ঘটনাস্থল থেকে প্রত্যেককে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। ফলে বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।’

বিবৃতি ছাড়া এনসিপিকে রক্ষায় কোনো দলই এগিয়ে আসেনি, একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবির এমন বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন।

তিনি বলেছেন, ‘গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতাদের ওপর যখন ভয়াবহ আক্রমণ হলো, পরে সব রাজনৈতিক দলকে তাদের পক্ষে বিবৃতি দিতে দেখেছি। কিন্তু ঘটনাস্থলে এনসিপিকে রক্ষা করার জন্য বা তাদের প্রতি সমর্থন হিসেবে অন্য কোনো সংগঠন এগিয়ে আসেনি।’ সঠিক সময়ে সঠিক কথাটিই বলেছেন দেশবরেণ্য এই সাংবাদিক।

সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরাও দেখেছি সবাই যেখানে কথার ফুলঝুরি ফোটোচ্ছেন সেই সময়ে গোপালগঞ্জে এনসিপির নেতাদের উদ্ধার করে নিরাপদে খুলনা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী প্রমাণ করেছে প্রতিটি সংকটে দেশের মানুষের প্রধান ভরসার জায়গায় রয়েছেন তারাই। 

অতীতেও দেশের প্রতিটি দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সশস্ত্র বাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়ানোর নানাবিধ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ছাত্র-জনতার রক্তস্রোতে সফল গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই শান্তিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে অচল করতে আনসার বিদ্রোহ, দাবি-দাওয়ার অজুহাতে নানা আন্দোলন, পরিকল্পিতভাবে গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিরতার ঘটনা ঘটে। মববাজি ও সড়ক-মহাসড়ক অবরোধও নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কঠিন মুহুর্তে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ প্রতিটি পরিস্থিতি সাহসের সঙ্গে মোকাবিলায় চরম ধৈর্য্য ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী।

দেশের স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, মাদক ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ হাজারো স্রহস্র প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে চড়াইউতরাই ভেঙে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থেকে সশস্ত্র বাহিনী গত ১১ মাসে প্রমাণ করেছে দেশের স্বার্থেই তারা নিবেদিতপ্রাণ। ‘সবার আগে দেশ’ এই নীতিতেই তারা বিশ্বাসী। ফলে দিনের শেষে সশস্ত্র বাহিনীর গভীর দেশপ্রেম, দায়িত্বশীলতা, সত্য ও ন্যায়ের জয় হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গোপালগঞ্জে চলমান এই রাজনৈতিক সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলায় জেলাটির জনসাধারণ অত্যন্ত ধৈর্যর সঙ্গে নিজেদের নিবৃত্ত রেখে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছেন বলে মন্তব্য করেছে। একই সঙ্গে বিবৃতিতে তারা সেনাবাহিনীর বলপ্রয়োগের কারণও তুলে ধরেছেন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘সেনাবাহিনী হামলাকারীদের মাইকে বারংবার ঘোষণা দিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে তারা সেনাবাহিনীর ওপর বিপুলসংখ্যক ককটেল ও ইটপাটকেল ছুড়ে হামলা করে। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ যৌথভাবে বিশৃঙ্খলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। অতঃপর সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় গ্রহণকারী ব্যক্তিদের খুলনায় স্থানান্তর করা হয়। সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী পেশাদারি ও ধৈর্যের সঙ্গে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।’

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক সন্ধানী বার্তা।