ঢাকা শনিবার, ০১ নভেম্বর, ২০২৫

বিভক্তির রাজনীতিতে টিকবে কি জাতীয় ঐক্য?

বিশেষ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২৫, ১১:৫৩ এএম
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। ছবি- সংগৃহীত

জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত জাতীয় রাজনৈতিক ঐক্য এখন টানাপোড়েনের মুখে। গণভোট, জুলাই সনদ ও নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের পর ঐক্যের যে বার্তা দেশজুড়ে আশার সঞ্চার করেছিল, সেটি এখন প্রশ্নের মুখে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নভেম্বরের পরেই স্পষ্ট হবে দলগুলোর এই ঐক্য কতটা টিকবে। তবে জাতীয় স্বার্থে ছাড় দিতে পারলে আবারও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাদের মতে, বর্তমানে যে অবিশ্বাস ও মতবিরোধ তৈরি হয়েছে, তা সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব।

ঐক্যের শেকড়ে ফাটল

জুলাই অভ্যুত্থানের সময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ ছিল প্রায় সব রাজনৈতিক দল। জনগণের শক্তিতে কেঁপে ওঠে স্বৈরশাসনের ভিত্তি। কিন্তু আন্দোলনের পর নতুন দেশ গড়ার অঙ্গীকারে এক কাতারে দাঁড়ালেও ধীরে ধীরে বাড়ছে বিভাজন। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট আয়োজন নিয়ে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে দলগুলোর মধ্যে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচনের দিন গণভোটে আমরা একমত হয়েছি জাতির স্বার্থে। এর বাইরে কোনো বিষয়ে একমত হবো না।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের নিশ্চয়তা চাই এটাই আমাদের স্পষ্ট দাবি।

এদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম অনৈক্যের জন্ম দিয়েছে বিএনপি এটা ইতিহাসে লিখে রাখার মতো ঘটনা।

সরকারের উদ্বেগ ও উপদেষ্টাদের হতাশা

অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টা রাজনৈতিক বিভক্তি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, এতদিন আলোচনার পরও যদি ঐকমত্য না আসে, তাহলে আমরা এখন কী করব, সেটা নিয়েই ভাবতে হচ্ছে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রস্তাবে মতবিরোধের কারণে এনসিপিসহ পাঁচটি দল এখনো স্বাক্ষর করেনি। যদিও ২৫টি দল সই করেছে, তাদের মধ্যেও গণভোটের সময়সূচি নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। জামায়াত নভেম্বরের আগে গণভোট চায়, আর বিএনপি চায় নির্বাচনের দিনই তা অনুষ্ঠিত হোক।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গণভোট বিতর্ক

রাজনৈতিক মাঠের মতোই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে ‘গণভোট হ্যাঁ বনাম না’ প্রচার। এক সময় গণভোটবিরোধী অবস্থানে থাকা বিএনপি নেতাকর্মীরা এখন পোস্ট দিচ্ছেন ‘না’, অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়রা ‘হ্যাঁ’ লিখে প্রচার চালাচ্ছেন। এতে জনমত বিভক্ত হলেও রাজনৈতিক উত্তাপ আরও বেড়েছে।

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে রাজনৈতিক বাস্তবতা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ মনে করেন, নভেম্বরের পরেই বোঝা যাবে ঐক্য টিকে থাকবে কি না। তবে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না। বিএনপি বা জামায়াত কেউই বয়কটের পথে যাবে বলে মনে করি না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এটাকে বড় অনৈক্য বলা যায় না। রাজনৈতিক দলগুলো কৌশলগতভাবে নিজেদের অবস্থান জানাতে এমন বক্তব্য দিচ্ছে। তবে বড় দলগুলোর উচিত জাতীয় স্বার্থে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা দেখানো।

ঐক্যের প্রয়োজনে সংলাপই সমাধান

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, গণতন্ত্রের বিকাশ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা পুনর্গঠন জরুরি। নির্বাচনের আগে যদি সংলাপের মাধ্যমে মতপার্থক্য কমানো না যায়, তাহলে জনগণের প্রত্যাশিত ঐক্য আবারও ভেঙে পড়বে।

তারা বলছেন, রাজনৈতিক কৌশল ও আদর্শের পার্থক্য থাকতেই পারে, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করার মানসিকতা না ফিরলে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সাফল্য টেকসই হবে না।

সর্বোপরি, দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে নভেম্বরের পরের সময়ের ওপর তখনই বোঝা যাবে, দলগুলোর এই ঐক্য স্থায়ী হবে নাকি নতুন বিভাজন সৃষ্টি করবে।