একটি রাষ্ট্র তখনই সভ্য ও মানবিক বিবেচিত হয় যখন সেই রাষ্ট্রে মানুষ তার প্রাপ্য মর্যাদা, অধিকার ও নিরাপত্তা পায়। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, আজকের বাংলাদেশে মানুষের মূল্য কোথায়!
প্রতিদিনের খবরে আমরা দেখি রাস্তায় গুলিতে প্রাণ যাচ্ছে, হাসপাতালে অবহেলায় শিশু মারা যাচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নারী ও শিশু, আবার বিচার না পেয়ে কেউ আত্মহত্যা করছে। একটি মানবিক সমাজে এমনটা কীভাবে ঘটতে পারে? যে সমাজে টাকা, পদ-পদবি আর ক্ষমতার কাছে মানুষ মূল্যহীন হয়ে পড়ে সে সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়।
সবশেষ গত ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উত্তরা শাখার দোতলা স্কুল ভবনে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমাদের জীবন কতটা মূল্যহীন, কতটা সস্তা। আছড়ে পড়া বিমান কেড়ে নিল পাইলটসহ অনেকগুলো শিশুর প্রাণ। অনেক শিশু হাসপাতালের বিছানায় পোড়া শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছে। পাঞ্জা লড়ছে মৃত্যুর সঙ্গে।
এই আকস্মিক মৃত্যু কি কেউ কল্পনা করেছিল। কিংবা যারা পোড়া শরীর নিয়ে অচেতনভাবে শুয়ে আছে হাসপাতালের বেডে তারা কি ভেবেছিল এই পরিণতি হবে তাদের? এর দায় আসলে কে নেবে? এটা ভাগ্যের লিখন হিসেবেই মেনে নিতে হবে।
অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয় এই এক দুর্ঘটনা। ঘুরেফিরে একটা কথাই সবার আগে মুখ থেকে বের হয়—মানুষের জীবনের দাম এত সস্তা কেন? গ্রাম হোক কিংবা শহর, এই দেশে মানুষের জীবনের দাম যেন মুরগির ডিমের দামের চেয়েও কম!
ডিমের কথা যখন উঠল তখন মুরগির কথাও একটু বলি, মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনার পর একটি গণমাধ্যমে এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটির প্রভাষক ড. আমিনুল ইসলামের একটি লেখা পড়ছিলাম। সেখানে তিনি সুইডেনের একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন, যা দেখে একই সঙ্গে আফসোস এবং রাগ দুটোই হচ্ছে।
তিনি লিখেছেন, ‘একদিন পত্রিকা হাতে নিয়ে একটা খবরের শিরোনাম দেখে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! শিরোনাম বলছে, ‘সুইডেনের বিমানবাহিনী একজন মুরগির খামারির কাছে ক্ষমা চেয়েছে’। শিরোনাম দেখে পড়ার ইচ্ছা হলো। বিস্তারিত পড়ে যা বুঝলাম, সেটা হচ্ছে, বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণরত বিমানগুলো খামারের উপর দিয়ে অস্বাভাবিকভাবে নিচু উচ্চতায় উড়ে গেছে । এতে যে বিকট শব্দ হয়েছে, তাতে কিছু মুরগি অন্যরকম আচরণ করতে শুরু করেছে। খামারি মুরগিগুলোর জন্য পশুচিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসক নাকি বলেছেন, বিকট শব্দের কারণেই ওরা এমন করছে!
খামারি বেচারা বিমান বাহিনীর নামে মামলা করে দিয়েছেন! কারণ, ওই এলাকায় এত নিচ দিয়ে বিমান উড়ে যাওয়ার কোনো বিধান ছিল না। শেষমেশ সুইডেনের বিমানবাহিনী তাকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এবং ক্ষমা চেয়েছে। তো, এই হচ্ছে সুইডেনের মানবাধিকার। সামান্য কিছু মুরগি অন্যরকম আচরণ শুরু করেছে। এ জন্য পুরো বিমানবাহিনী একজন খামারির কাছে ক্ষমা চেয়েছে।
বাংলাদেশে বসবাস করে আমরা কি এটা চিন্তাও করতে পারি? কোনো খামারির কি সাহস হবে, একটা বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা করে দেওয়ার? খামারির কথা বাদই দিলাম; দেশের প্রথম শ্রেণির কোনো নাগরিকেরই কি এই সাহস হবে?
রাষ্ট্রের ভুলে মানুষ মরলে রাষ্ট্র শুধু শোকবার্তা দিয়েই চুপ থাকে। উন্নত বিশ্বে রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে মানুষও উন্নত কিন্তু আমরা?
ট্রেনের নিচে কাটা পড়া লাশের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষ সেলফি তুলি। সড়কে অ্যাক্সিডেন্ট হলে অনেকে দাঁড়িয়ে মোবাইল বের করি ভিডিও করার জন্য, সাহায্যের জন্য নয়। এর চেয়ে বড় মূল্যহীনতা আর কী হতে পারে?
আমাদের রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাসহ সবখানেই এখন এক ধরনের ‘মানবিকতার খরা’। একজন গরিব কৃষকের মৃত্যু যেমন সহজে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রকে নাড়া দেয় না, ঠিক তেমনি একজন খেটে খাওয়া মানুষের কান্না রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কাছে পৌঁছায় না। কারণ আমাদের সমাজে এখন ‘কাকে চেনো’ এই প্রশ্নটাই বড়, ‘তুমি কে?’ সে প্রশ্নের আর কোনো মূল্য নেই।
এই মূল্যহীনতার জাল থেকে মুক্তি পেতে হলে দরকার একটি শক্তিশালী সামাজিক জাগরণ, দরকার নৈতিকতা ও মানবিকতানির্ভর শিক্ষা এবং দরকার রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে জবাবদিহিতা। রাষ্ট্রযন্ত্রকে বুঝতে হবে, মানুষই রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি। তাদের উপেক্ষা করে উন্নয়ন সম্ভব নয়, টেকসই তো নয়ই।
আজ আমাদের দাঁড়াতে হবে আয়নার সামনে। জিজ্ঞাসা করতে হবে, আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমরা কি এমন এক বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, যেখানে মানুষের জীবন এক নিমিষেই মূল্যহীন হয়ে পড়ে?
এই প্রশ্নের উত্তর আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। না হলে হয়তো একদিন সত্যিই আমাদের বলতে হবে এই দেশে মানুষের কোনো মূল্য নেই!
এই রাজধানী ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি। এই শহরের ওপর দিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণরত বিমান কেন উড়বে? দেশে কি আর কোনো জায়গা ছিল না? প্রশিক্ষণ যদি নিতেই হয়, অনেক ফাঁকা জায়গা আছে, নদী-নালা, খাল-বিল আছে; কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা আছে। ঢাকায় কেন? এই প্রশ্নগুলো আমাদের ভাবিয়ে যাচ্ছে দুর্ঘটনার পর থেকেই।
যে বিমানের মেয়াদ শেষ, সেই বিমান উড়ছে আকাশে সেইসঙ্গে তা দিয়ে চলছে প্রশিক্ষণ! আমাদের কর্তা-ব্যক্তিদের ঘুম কবে ভাংবে? এই যে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, এই লেখা যখন লিখছি, প্রায় ৩২ জন মারা গেছে শতাধিক বাচ্চা আগুনে পুড়ে বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছে। এর দায় কার?
ঘটনাস্থলে আমরা উৎসুক মানুষের দেখতে পেয়েছি। রাজনীতিবিদরা এমন একটা পরিস্থিতিতেও দলবল নিয়ে হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছেন, যা কিছুটা হলেও চিকিৎসাসেবাকে ব্যাহত করেছে। এমন একটা ট্র্যাজিডির মধ্যেও তাদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে হবে?
এত এত হতাশার মাঝে আমাদের একটু হলেও আশার আলো দেখালেন মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী। নিজের জীবন তুচ্ছ করে কতগুলো শিক্ষার্থীকে বাঁচালেন এই মহীয়সী। তার আত্মত্যাগ আমাদের সাহসী করে, একই সঙ্গে প্রশ্ন তোলে, সমাজে তার মতো সাহসী, আত্মদানকারী মানুষ আর ক’জন আছে?
বিমান দুর্ঘটনার পর কেউ কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেন, আবার ঘটনার ভিডিও করতে ব্যস্ত হয়েছেন অনেকেই। অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি দিয়ে ‘ভাইরাল’ হতে চেয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতালে আহতদের নিয়ে যেতে রিকশাচালক ও সিএনজি ড্রাইভার হাঁকিয়েছেন কয়েকগুণ ভাড়া। শুনলাম, এক লিটার পানিও নাকি বিক্রি হয়েছে ৫০০-৬০০ টাকায়। এখানেই উঠে আসে আমাদের বর্তমান নৈতিকতার প্রশ্ন। একটি মৃত্যুর মুহূর্ত কি কেবল একটি ক্লিকবেইট কনটেন্ট হয়ে দাঁড়াবে? নাকি আমরা কিছুটা নীরব শ্রদ্ধা, কিছুটা সহানুভূতি দেখাতে শিখব?
আজ আমাদের সমাজে ‘ভালো মানুষ’ হতে সাহস লাগে। কারণ কেউ যখন আত্মত্যাগ করে, তখন অনেকেই সেটাকে বোকামি বলে মনে করে। এই মানসিকতা আমাদের সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অথচ এই সমাজে দরকার ছিল এমন কিছু মানুষ, যারা বিপদের সময় ছুটে আসবে, নিজেরটা না ভেবে অন্যের প্রাণ বাঁচাবে।
মাইলস্টোনের দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, মানবিকতায় আমরা কতটা পিছিয়ে। এমন সময় আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করানো উচিত। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করা দরকার, কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমি আমরা। শিক্ষার্থীদের বাঁচিয়ে দেওয়া সেই নারীর আত্মত্যাগ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, কীভাবে ভালো মানুষ হওয়া যায়, কীভাবে একজন মানুষের জীবন আরেক মানুষের কাছে হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার। তাহলেই আমরা প্রকৃত মানুষ হতে পারব। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
আমরা যদি সত্যিই এই দুর্ঘটনা থেকে কিছু শিখতে চাই, তাহলে কেবল দায় চাপানো, শোক প্রকাশ কিংবা ভিডিও ভাইরাল করা নয়। আমাদের নৈতিকতা ফিরিয়ে আনা দরকার। সাহস, সহানুভূতি আর আত্মত্যাগ এই তিনটি শব্দই হোক ভবিষ্যতের বাংলাদেশের পরিচয়।