ঢাকা বুধবার, ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

আরটির বিশ্লেষণ

সাংহাই সম্মেলনের বার্তা ‘পশ্চিমা আধিপত্যের যুগ শেষ’

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২, ২০২৫, ০২:৫৯ পিএম
সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। ছবি- সংগৃহীত

চীনে অনুষ্ঠিত সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলন ইতোমধ্যেই ২০২৫ সালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি বহুমেরু বিশ্বের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে এসসিও’র ক্রমবর্ধমান ভূমিকার ওপর জোর দেয় এবং সার্বভৌম উন্নয়ন, হস্তক্ষেপ না করা ও বিশ্বায়নের পশ্চিমা মডেল প্রত্যাখ্যানের নীতির চারপাশে গ্লোবাল সাউথের একীকরণকে সামনে আনছে।

সম্মেলনকে বিশেষ প্রতীকী মাত্রা দিয়েছে আসন্ন ৩ সেপ্টেম্বর বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিতব্য সামরিক কুচকাওয়াজ, যা চীন-জাপান যুদ্ধে বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকী ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি স্মরণে আয়োজিত হবে। চীনে এই ধরনের কুচকাওয়াজ খুবই বিরল, সর্বশেষ কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক দশক আগে। এবারের আয়োজন বেইজিংয়ের রাজনৈতিক আত্মপরিচয়, ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা ও বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশের একটি ব্যতিক্রমী মুহূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শীর্ষ সম্মেলন ও আসন্ন কুচকাওয়াজ উভয়ের প্রধান অতিথি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তার উপস্থিতি প্রতীকী গুরুত্বের পাশাপাশি কৌশলগত তাৎপর্যও বহন করছে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভাঙনের প্রেক্ষাপটে মস্কো এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের মধ্যে সেতুবন্ধনের ভূমিকা আরও জোরালোভাবে তুলে ধরছে।

ভাষণে পুতিন ২০৩৫ সাল পর্যন্ত এসসিও উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন, যা আগামী এক দশকের কৌশলগত পথ নির্ধারণ করবে এবং সংগঠনটিকে অর্থনৈতিক, মানবিক ও অবকাঠামোগত উদ্যোগের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ প্ল্যাটফর্মে পরিণত করবে।

পাশাপাশি চীনের প্রস্তাবিত এসসিও উন্নয়ন ব্যাংকের প্রতি মস্কোর সমর্থন বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এই ব্যাংক যৌথ বিনিয়োগ ও অবকাঠামো প্রকল্প অর্থায়নের বাইরে গিয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমা আর্থিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা কমাতে ও নিষেধাজ্ঞার প্রভাব হ্রাসে সহায়তা করতে পারে।

শি জিনপিং, ভ্লাদিমির পুতিন ও নরেন্দ্র মোদি। ছবি- সংগৃহীত

বেইজিং জানিয়েছে, পুতিনের সফর বাস্তবিক ও প্রতীকী উভয় দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। মস্কো ও বেইজিং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে এনে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও ঐতিহাসিক সত্য রক্ষার অঙ্গীকার জোরালো করেছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অংশগ্রহণ নয়াদিল্লির কৌশলগত নমনীয়তা ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের প্রস্তুতি প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপের পটভূমিতে এই সফর ভারতের স্বায়ত্তশাসনের একটি স্পষ্ট ঘোষণা। উদ্বোধনী দিনে শি জিনপিং ও মোদির দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ছিল বিশেষ আকর্ষণ। সাত বছরের মধ্যে এটি মোদির প্রথম চীন সফর। 

সীমান্ত বিরোধ অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও ওয়াশিংটনের শুল্ক আরোপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দুই দেশ ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

জিনপিং বলেন, চীন ও ভারত মহান সভ্যতা, যাদের দায়িত্ব দ্বিপাক্ষিক বিষয়ের বাইরেও বিস্তৃত, এবং ভবিষ্যৎ নিহিত রয়েছে ‘ড্রাগন ও হাতির নৃত্য’-এ। মোদি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে অংশীদারিত্ব হিসেবে অভিহিত করে সরাসরি বিমান চলাচল পুনরায় চালু করার ঘোষণা দেন, ন্যায্য বাণিজ্যের ওপর জোর দেন এবং চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে তৃতীয় পক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত নয়।

এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়া আবারও মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছে, চীন-ভারত উত্তেজনা কাজে লাগিয়ে গ্লোবাল সাউথে ভাঙন আনার পশ্চিমা প্রচেষ্টা রোধ করেছে। ভারতের জন্য অগ্রাধিকার হলো বহুপাক্ষিক কাঠামো, যা বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার বহুকেন্দ্রিক রূপ গড়ে তোলে।

নয়াদিল্লি ধারাবাহিকভাবে বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের অধিকারকে রক্ষা করেছে এবং এসসিও থেকে ব্রিকস পর্যন্ত উদ্যোগগুলোতে অংশগ্রহণকে সার্বভৌমত্ব ও বৈশ্বিক প্রভাব বৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবে দেখছে। একইসঙ্গে ভারত কূটনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাত এড়িয়ে চলে। তবুও বার্তাটি স্পষ্ট- নয়াদিল্লি বাইরের নির্দেশ মানবে না, বিশেষত জাতীয় ও আঞ্চলিক অগ্রাধিকার সম্পর্কিত বিষয়ে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের অংশগ্রহণও তাৎপর্যপূর্ণ। ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রের নেতা হিসেবে তার উপস্থিতি আঙ্কারার আরও সার্বভৌম পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তোলার ইঙ্গিত দেয়। আঙ্কারা এসসিও’র মধ্যে ভূমিকা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, যা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুরস্ক নিজেকে ইউরেশিয়ার স্বাধীন শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করছে, যা পরিবহন করিডোর ও জ্বালানি বাজারের মতো কৌশলগত সম্পদে প্রবেশাধিকার সুরক্ষিত করার লক্ষ্য রাখছে।

শীর্ষ সম্মেলনে মধ্য এশিয়ার মূল দেশগুলোর পাশাপাশি বেলারুশ, ইরান ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টরা যোগ দেন। মালয়েশিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান পূর্ণ সদস্যপদে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এতসব সমীকরণের হিসাব-নিকাশ থেকে বিশেষভাবে লক্ষণ বলা যায়, এসসিও কেবল ইউরেশিয়া নয়, বরং বিকল্প বিশ্বায়নের একটি কেন্দ্রবিন্দুতে রূপ নিচ্ছে।

সম্মেলনের অন্যতম ফল ছিল তিয়ানজিন ঘোষণা, যা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, বলপ্রয়োগ বা হুমকি প্রত্যাখ্যান ও একতরফা নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করার মতো নীতিগুলো নির্ধারণ করেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ঘোষণায় ইউক্রেনের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। গ্লোবাল সাউথের দৃষ্টিতে, অগ্রাধিকার বিশ্বব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, বৈঠকের মূল ফল ছিল এসসিও+ দেশগুলোর বৈধ স্বার্থ রক্ষার অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি।

চীনের এই শীর্ষ সম্মেলন কেবল কর্মসূচি নির্ধারণই করেনি, বরং বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থাকে দৃঢ়ভাবে সামনে এনেছে। বহুমেরুত্ব আর তত্ত্ব নয়, এটি এসসিওতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে এবং ক্রমশ গ্লোবাল সাউথজুড়ে কর্তৃত্ব অর্জন করছে। বর্তমানে প্রায় ১০টি দেশ পর্যবেক্ষক বা সংলাপ অংশীদার হিসেবে যোগদানের আবেদন করেছে, যা এসসিওকে বিকল্প ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে ক্রমবর্ধমান আগ্রহের প্রমাণ।

আরব বিশ্বের আগ্রহও উল্লেখযোগ্য। বাহরাইন, মিশর, কাতার, কুয়েত, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতোমধ্যেই সংলাপ অংশীদার। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ইউরেশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যকে সংযুক্তকারী নতুন ভূ-অর্থনৈতিক অক্ষের বাস্তব রূপের ইঙ্গিত দেয় এবং পশ্চিমাকেন্দ্রিক মডেলের বিকল্প হিসেবে এসসিওকে আরও শক্তিশালী করে।

শীর্ষ সম্মেলনের স্পষ্ট বার্তা

এসসিও আজ আর কেবল আঞ্চলিক কাঠামো নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতিতে কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দু। এটি বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার দেশগুলোকে একত্র করে, সার্বভৌমত্ব রক্ষার অঙ্গীকার করে, নিজস্ব উন্নয়ন মডেলকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং ন্যায্য বিশ্বব্যবস্থার দাবি তোলে।

একসময় যাকে শিথিল আঞ্চলিক ক্লাব হিসেবে দেখা হতো, সেটি এখন গ্লোবাল সাউথের জন্য একটি ভূ-রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম, যা সদস্যপদ বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রভাব এবং অভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে পশ্চিমা আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করছে।

অর্থাৎ বেইজিং থেকে প্রতিধ্বনিত হলো এই বার্তা যে, পশ্চিমা আধিপত্যের যুগ শেষ। বহুমেরুত্ব এখন বিশ্ব রাজনীতির বাস্তবতা এবং এসসিও তার প্রধান চালিকাশক্তি।


লেখক: ফরহাদ ইব্রাগিমভ, প্রভাষক, অর্থনীতি অনুষদ, আরইউডিএন বিশ্ববিদ্যালয় একং ভিজিটিং লেকচারার, রাশিয়ান প্রেসিডেন্সিয়াল একাডেমি অব ন্যাশনাল ইকোনমি অ্যান্ড পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস।