বাংলাদেশে প্রকৌশল শিক্ষার কাঠামোতে ডিপ্লোমা ও বিএসসি দুই ধাপেই আলাদা শিক্ষাগত যোগ্যতা, কর্মক্ষেত্র এবং দায়িত্ব নির্ধারিত রয়েছে। ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্নকারীরা মাঠপর্যায়ের কারিগরি কাজে দক্ষ, আর বিএসসি ইঞ্জিনিয়াররা মূলত পরিকল্পনা, নকশা ও ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্ব দেন। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, অনেক বিএসসি ডিগ্রিধারী উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে আবেদন করছেন, যা শুধু তাদের যোগ্যতার অবমূল্যায়নই নয়- পেশাগত কাঠামো ও কর্মপরিবেশে জটিলতাও সৃষ্টি করছে। বাস্তবতা হলো, একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারের এই পদে কাজ করা শিক্ষাগত, পেশাগত ও নৈতিক দিক থেকে কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।
পাঠক চলুন ডিপ্লোমা এবং বিএসসির শিক্ষাগত কাঠামো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক-
* ডিপ্লোমা- এসএসসি বা সমমানের পাসের পর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ৪ (চার) বছরের ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ডিপ্লোমা- ২০২০ সালের বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের গেজেটে ডিপ্লোমাধারীদের ‘ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যা তাদের পেশাগত মর্যাদার আইনি ভিত্তি দেয়।
* বিএসসি- এইচএসসি বা সমমানের পাসের পর বুয়েট, রুয়েট, চুয়েট ও কুয়েটের মতো প্রকৌশল বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪ (চার) বছরের ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
চাকরি/পদবি:
* ডিপ্লোমা- দশম গ্রেডের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে শুধু ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরাই আবেদন করতে পারেন। ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরা দীর্ঘদিন কর্ম যোগ্যতার ভিত্তিতে তারা নবম গ্রেড পর্যন্ত পদন্নোতি পান।
* বিএসসি- নবম গ্রেডের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সহকারী প্রকৌশলী পদে বিএসসি ডিগ্রিধারীরাই আবেদন করতে পারেন। বিএসসি ডিগ্রিধারীরা নবম গ্রেড থেকে ১ম গ্রেড পর্যন্ত পদন্নোতি পান এবং বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন, যা ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরা পারেন না।
মতামত:
একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে কাজ করা উপযুক্ত নয়, বরং বাস্তবসম্মত ও পেশাগত যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
যোগ্যতার ভিন্নতা
বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার এবং উপ-সহকারী প্রকৌশলীর পদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দায়িত্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার:
চার বছরের স্নাতক ডিগ্রিধারী একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারের তাত্ত্বিক জ্ঞান অনেক গভীর। তারা মূলত নকশা প্রণয়ন, পরিকল্পনা, গবেষণা ও ব্যবস্থাপনার মতো উচ্চতর কাজগুলোর জন্য যোগ্য।
উপ-সহকারী প্রকৌশলী:
এই পদের জন্য সাধারণত ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি কারিকুলাম যথেষ্ট এবং কারিগরি জ্ঞান গভীর। তাদের প্রধান কাজ হলো মাঠপর্যায়ে তদারকি, পরিমাপ, এবং কারিগরি কাজগুলো বাস্তবায়ন করা।
পদমর্যাদা ও কার্যক্ষেত্রের দ্বন্দ্ব
একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার যদি উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন, তবে তা পেশাগত পদমর্যাদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। পেশাগত সম্মান: উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে নি¤œ পদে কাজ করলে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারের মেধা ও দক্ষতার সঠিক মূল্যায়ন হয় না। এটি তার পেশাগত সম্মানের জন্যও ক্ষতিকর।
কার্যক্ষেত্রে জটিলতা:
একটি প্রতিষ্ঠানে সাধারণত উপ-সহকারী প্রকৌশলীরা সহকারী প্রকৌশলীদের (যে পদটি বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য নির্ধারিত) অধীনে কাজ করেন। ফলে, একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারকে তার নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী উচ্চপদে থাকা সহকর্মীর অধীনে কাজ করতে হতে পারে, যা কর্মপরিবেশে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
কর্মজীবনের অগ্রগতিতে বাধা
এই ধরনের নিয়োগ একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারের কর্মজীবনে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সীমিত সুযোগ:
উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদের পদোন্নতির সুযোগ বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য নির্ধারিত সহকারী প্রকৌশলী পদের চেয়ে কম। এই পদে আটকে থাকলে তার পেশাগত উন্নতির পথ সংকুচিত হয়ে যায়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:
একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারের উচিত তার যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে সহকারী প্রকৌশলী বা আরও উচ্চপদে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করা, যেখানে তিনি তার অর্জিত জ্ঞান পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারবেন এবং তার ক্যারিয়ার দ্রুত অগ্রসর হবে।
একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে কাজ করা উপযুক্ত নয়! বর্তমানে বিএসসি ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীরা যেভাবে নিজেদের নিচের দিকে নামাচ্ছেন এটা লজ্জাজনক।
প্রকৌশল শিক্ষার প্রতিটি ধাপে নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও মর্যাদা নির্ধারিত আছে। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা মাঠপর্যায়ের বাস্তবায়নে অপরিহার্য, আর বিএসসি ইঞ্জিনিয়াররা নকশা ও পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেন। তাই একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগদান করা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।
এটি যেমন তার নিজের পেশাগত সম্মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তেমনি কর্মক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও জটিলতাও তৈরি করে। প্রয়োজন হলো প্রত্যেকে নিজের যোগ্যতার মর্যাদা রক্ষা করে দায়িত্ব পালন করা। তবেই প্রকৌশল পেশার সার্বিক অগ্রগতি নিশ্চিত হবে।
মো. ইমরান
প্রকৌশলী এবং শিক্ষক