এ দেশের মানুষের কাছে ভোট একটি উৎসব। বিগত অনেকটা সময় হওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। ফলে ভোটাধিকার প্রয়োগ হয়নি ঠিকমতো। মানুষের মাঝে এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ ছিল। আর এ ক্ষোভের ফসল গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান।
এ অভ্যুত্থানে একটি সরকারের পতন হয়েছে। জাতি নতুন করে একটি সর্বাঙ্গীন ও সুন্দর ভোট উৎসবের অপেক্ষায়। প্রায় ১৭ বছর ভোট উৎসবের অভাব মিটে যাবে তাতে, এ আশাই সবার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বছরের ৮ আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণ করেই বলেছিলেন দেশ নির্বাচনী ট্রেনে উঠে গেছে। তারপরও নানা অনিশ্চয়তা ছিল।
প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করে ঘোষণা দিয়েছেন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি প্রথমার্ধে দেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এ নির্বাচন আয়োজনে সকল প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সংশ্লিষ্টরা। আর দেশে ইতোমধ্যে নির্বাচনী আমেজ বইছে। তৃণমূল থেকে রাজধানী; সম্ভাব্য প্রার্থীরা সরব। সব দলই ভোটের হাওয়ায় জনগণকে মাতাতে উঠে-পড়ে লেগেছে।
শুরুতেই বলেছি, ভোট এ দেশে উৎসবের আমেজ নিয়ে আছে। ভোটের সময় দেশের অর্থনীতিও বদলে যায়। অঘোষিত বা অপ্রকাশ্য অর্থের নাড়াচাড়াও চলে। ভোট অর্থনীতির চিত্রও বদলে দেয়। সব মিলিয়ে ভোট এ দেশবাসীর মাঝে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনই একটি গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ, একটি দেশব্যাপী উৎসবের আবহ তৈরি করে। তবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন কিছুটা ব্যতিক্রম।
দীর্ঘ সতেরো বছর পর এমন একটি সময় এসেছে, যখন দেশজুড়ে ভোটকে ঘিরে ফিরে এসেছে এক প্রাণবন্ত আবহ, মানুষের মুখে মুখে আলোচনার ঝড়, প্রত্যাশার ঢেউ এবং একটি সম্মিলিত উচ্ছ্বাস। রাজনৈতিক মতপার্থক্য কিংবা মতাদর্শগত বিভাজন থাকলেও এই নির্বাচন যেন সবাইকে একত্রিত করেছে এক বিশাল জাতীয় আয়োজনে অংশগ্রহণের অভিন্ন আনন্দে।
নির্বাচন কমিশন রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। তফসিল ঘোষণার বাকি আছে। সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা চূড়ান্তকরণ, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন ও দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন চূড়ান্ত করাসহ ২৪টি গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলিকে প্রাধান্য দিয়ে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে ইসি।
ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে এবং তফসিল ঘোষণা করা হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে। ইসি সংশ্লিষ্টরা জানান, ভোট গ্রহণের ৬০ দিন আগে তফসিল দেওয়া হবে।
তফসিল ঘোষণার পর সারা দেশ ভোটের উন্মাদনায় ভাসবে। ভোটগ্রহণের দিন নিয়ে এক ধরনের কাউন্টডাউন শুরু হবে। যত দিন গড়াবে উৎসব তত ভিন্ন মাত্রা পাবে। বলা চলে উৎসব সবে শুরু হয়েছে। সারাদেশে ভোট উৎসবে এখন থেকেই ব্যাপক সাড়া মিলছে।
এখন থেকেই শহর, মফস্বল, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামেও ভোট নিয়ে মানুষের আগ্রহ যেন চোখে পড়ার মতো। দলীয় রাজনীতির বাইরেও সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ভোট দেওয়ার একটি স্বতঃস্ফূর্ত আকাঙক্ষা জেগে উঠেছে, সেটিই এই নির্বাচনের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক।
যারা আগে কখনো ভোট দেননি, এমন তরুণ প্রজন্ম এবার উৎসাহের সঙ্গে ভোটার তালিকায় নাম নিবন্ধন করেছে। অনেকে প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছেন, যেন এটি তাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অভিষেক।
যুগের হাওয়ায় ভর করে অনেক কিছুই বদলে গেছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় যেমন মানুষের জীবনধারায় এসেছে পরিবর্তন, তেমনি মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতাও বেড়েছে বহুগুণ। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক খবরের প্রতি আগ্রহ, নীতি ও নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রবণতা প্রমাণ করে তারা আর কেবল দর্শক নয়, সক্রিয় নাগরিক হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
আর সেই সক্রিয়তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ হচ্ছে ভোটাধিকার প্রয়োগ। তাই এবারের নির্বাচন কেবল একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়াই নয়, বরং জনগণের অংশগ্রহণে এক মহোৎসব হয়ে উঠবে এই প্রত্যাশা সবার।
যতই রাজনৈতিক বিশ্লেষণ হোক না কেন, সাধারণ মানুষের কাছে নির্বাচন মানেই ভোট দেওয়ার আনন্দ, নিজের মত প্রকাশের সুযোগ এবং ভবিষ্যতের জন্য একজন প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার। এই অধিকার চর্চা করতে পারাটা মানুষকে গর্বিত করে, আশাবাদী করে তোলে। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি, প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনা, পোস্টার, মাইকিং, নির্বাচনী সভা সবকিছু মিলিয়ে যে প্রাণবন্ত পরিবেশ তৈরি হয়, তা আমাদের সংস্কৃতিরই একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশজুড়ে দেখা যাচ্ছে এক অভূতপূর্ব উৎসাহ। নারী, পুরুষ, তরুণ, বয়োজ্যেষ্ঠ সবাই যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন ভোটের জন্য। অনেকে ইতোমধ্যেই পরিবার, বন্ধু বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলোচনা করছেন কাকে ভোট দেবেন, কেন দেবেন, কোন প্রার্থী এলাকার জন্য কী কাজ করেছেন, কে কতটা যোগ্য নেতা ইত্যাদি। এমন পরিবেশ গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আশাব্যঞ্জক।
বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মধ্যে যে রকম উদ্দীপনা লক্ষ করা যাচ্ছে, তা অনুকরণীয়। সামাজিক মাধ্যমে নিজের ভোটার হওয়ার তথ্য শেয়ার, ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা পেতে উদগ্রীব হওয়া, এমনকি ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার পরিকল্পনা সবই প্রমাণ করে যে তারা এই প্রক্রিয়ার অংশ হতে যাওয়ার বিষয়ে শিহরিত। তরুণদের এই অংশগ্রহণ দেশকে নতুন নেতৃত্ব, নতুন চিন্তাধারা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির আরো বিকাশের দিকে নিয়ে যাবে বলেই বিশ্বাস করা যায়।
এবারের নির্বাচনকে ঘিরে নারীদের অংশগ্রহণও অত্যন্ত উৎসাহজনক। গ্রামের গৃহবধূ থেকে শুরু করে শহরের চাকরিজীবী নারী, সবারই মুখে ভোটের গল্প। নারীদের আত্মবিশ্বাস, সক্রিয়তা প্রমাণ করে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র কেবল পুরুষদের হাতেই সীমাবদ্ধ নয় নারীরাও এখন নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতায় অংশীদার।
এ ছাড়া প্রবাসীদের মধ্যেও এক ধরনের আবেগ কাজ করছে। তারা যেন ডাক যোগে অর্থাৎ পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে নির্বাচন কমিশন। এখন দেখার বিষয় উদ্যোগটি কতটা সুনিশ্চিৎ করা যায়। প্রবাসীরা সবসময় ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। তারপরও তারা খোঁজ রাখেন দেশে নির্বাচনী পরিস্থিতি কেমন, কোন দল কেমন প্রচার করছে, কোন প্রার্থী এলাকায় কী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের ফোন করে তারা নিজের মতামত দেন, উৎসাহ দেন ভোট দেওয়ার জন্য। এবার তারা ভোট দেওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। এটি অবশ্যই ভিন্ন আবহের সৃষ্টি করবে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সর্বজনীন আগ্রহ ও সক্রিয়তা দেখে মনে হয়, দেশ যেন সত্যিই এক উৎসবমুখর পরিবেশে প্রবেশ করতে চলেছে। শহরের অলিগলি, গ্রামের বাজার, হাট, চায়ের দোকান সবখানেই এখন নির্বাচন নিয়েই আলোচনা। কারও পছন্দ এক দল, কারও ভরসা অন্য প্রার্থী তবু সবার কণ্ঠে একটি কথাই ঘুরেফিরে আসছে, ‘ভোট দেব স্বাধীন মনোভাব নিয়ে। নিজের প্রতিনিধি নিজেরাই ঠিক করব।’
ভোটের দিনটা অনেকের কাছে যেন ঈদের দিনের মতো। পরিচিত এক আনন্দ, প্রস্তুতির রোমাঞ্চ, প্রিয়জনদের সঙ্গে কেন্দ্রে যাওয়া সব মিলিয়ে দিনটি হয়ে ওঠে স্মরণীয়। শিশু-কিশোররাও খুশি থাকে, যদিও তারা ভোট দিতে পারে না, তবু তাদের পরিবারে, পাড়ায় যে উৎসবের আবহ তৈরি হয়, তাতে তারাও অংশ নেয়।
এই উচ্ছ্বাসের মাঝে আছে এক ধরনের জাতিগত ঐক্যবোধ। সবাই মিলে একসঙ্গে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আনন্দ। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, বরং সামাজিক বন্ধনেরও প্রতিফলন।
মানুষের সামাজিক অংশগ্রহণ, এই প্রত্যাশা ও উচ্ছ্বাসই গণতন্ত্রের শক্তি। সরকারের পরিবর্তন হোক বা না হোক, দল বদলাক বা একই দল ক্ষমতায় থাকুক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মানুষ যেন বিশ্বাস করতে পারে যে তাদের কণ্ঠস্বর শোনা হচ্ছে, তাদের ভোটের মূল্য আছে এবং সেই ভোটের মাধ্যমেই দেশ গঠনে তারা সক্রিয়ভাবে যুক্ত।
এবারের নির্বাচন নিয়ে যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে, তা একদিনে হয়নি। এর পেছনে রয়েছে বছর বছর ধরে জমে থাকা হতাশা, অবহেলার বেদনা, অংশগ্রহণের সুযোগ না পাওয়ার আক্ষেপ। তাই এবার যখন সেই সুযোগ এসে গেছে, তখন মানুষ আর কোনোভাবেই পেছনে ফিরতে চায় না। তারা প্রস্তুত, তারা দৃঢ়, তারা আগ্রহী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতেই হবে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তাই কেবল একটি নির্বাচন নয়, বরং এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের পুনরায় প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা। এ যেন বহুদিন পর নিজের মালিকানা ফিরে পাওয়া, নিজের মত প্রকাশের অধিকার পুনরুদ্ধার করার উপলক্ষ। এই উপলক্ষকে ঘিরেই সারা দেশে যে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তা অবশ্যই আশার আলো জ্বালায়।
এখন শুধু প্রয়োজন, এই নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়। যেন প্রতিটি ভোটার নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভোট দিতে পারেন। কোনো সহিংসতা বা অনিয়ম না ঘটে, যাতে এই জাতীয় উচ্ছ্বাস ভরাডুবি না হয়।
বাংলাদেশের মানুষ প্রমাণ করেছে, তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই গড়তে চায়। আর সেই গড়ার হাতিয়ার তাদের হাতে এখন একটি শক্তিশালী অস্ত্র ভোট। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই উচ্ছ্বাস, এই অপেক্ষা, এই আনন্দই দেখিয়ে দেয় এই দেশ এখনো মানুষের, এই দেশ এখনো আশার।
অনেক কষ্ট ও সংগ্রামকে সাথি করে মানুষ দেশকে নিয়ে বুক বাঁধে। শত প্রতিকুলতা জয় করে মানুষ আগামীর দিকে চেয়ে রই। তারই অংশ ভোটাধিকার প্রয়োগ। পাঁচ বছর একটি দলকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এখন থেকে মানুষের ভোটাধিকারের মর্যাদা দিতে হবে জয়ী দলকে। না হয় মানুষের হাতেই করুণ পরিণতি। অতীতের শিক্ষা তাই বলে। পুরো দেশকে নিয়ে একটি শঙ্কামুক্ত ভোট উৎসবের প্রতীক্ষা-অপেক্ষা সব রইল।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন