আজকের শিশু আগামী দিনের বাংলাদেশ। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের বুনিয়াদ হওয়া উচিত একটি বিষমুক্ত, নিরাপদ খাদ্যব্যবস্থা। বাজারের বাস্তবতায় নকল রং, ক্ষতিকর কেমিক্যাল, ভেজাল উপাদান ও প্রতারণা শিশুদের ভবিষ্যৎকে গোড়া থেকেই বিপন্ন করছে। এই সংকট শুধু স্বাস্থ্যহানি নয়, এটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতোই গুরুতর।
বাজারে ভেজাল দুধ ও শিশুখাদ্যের ভয়াবহতা
প্যাকেটজাত তরল ও গুঁড়া দুধের ওপর নির্ভরতা বাড়লেও উৎপাদনের ঘাটতি মেটাতে অনেকে ভেজাল পথে হাঁটছে। ছানার পানি, কাপড় কাঁচা সোডা, তেল, লবণ ও চিনি মিশিয়ে ‘খাঁটি দুধ’ বানানোর মতো কৌশল শিশুদের জন্য সরাসরি বিষ সমতুল্য। নামি ব্র্যান্ডের সিল, লোগো ও প্যাকেট নকল করে বাজারে তোলা পণ্যগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকে প্রতারণা। আর ভোক্তা জানতেও পারে না তিনি কাকে বিশ্বাস করছেন।
শুধু দুধ নয়, আইসক্রিম, চিপস, চকলেট, বিস্কুট, গুড়সহ অনেক পণ্যে কেমিক্যাল ও ক্ষতিকর রঙের ব্যবহার শিশুদের পেটের সমস্যাসহ দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ায়। এই বিপন্নতা কেবল মান পরীক্ষায় ধরা পড়ে না; নিরাপত্তা পরীক্ষায় আরও গভীর ঝুঁকি প্রকাশ পায়। বাজারে খাদ্যের গুণগতমান যাচাই না হওয়া পর্যন্ত কেবল চকচকে প্যাকেট বা বড় নামের ওপর আস্থা রাখা আত্মঘাতী।
চট্টগ্রামে মোবাইল কোর্ট অভিযান
১ ডিসেম্বর ২০২৫, হামজারবাগ এলাকায় জেলা প্রশাসন চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের যৌথ মোবাইল কোর্ট অভিযানে মেসার্স পারভেজ ফুড প্রোডাক্টস লি.-এ প্রবেশ করে দেখা যায়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, যথাযথ নিবন্ধন ছাড়াই শিশুখাদ্য উৎপাদন এবং বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন কোম্পানির লোগো নকল করে মোড়কজাতের মতো গুরুতর অনিয়ম। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিকে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড প্রদান ও তাৎক্ষণিক আদায় করা হয়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে জনস্বার্থে এ ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এটা প্রমাণ করে আইন আছে; প্রয়োগের ধারাবাহিকতা ও কঠোরতা বাড়লেই ফল মিলবে।
শিশুদের স্বাস্থ্যে ভেজাল খাদ্যের প্রভাব
ভেজাল ও দূষিত খাদ্য শিশুদের দেহকোষ, মস্তিষ্ক, কিডনি, লিভারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা ও আচরণগত জটিলতা বাড়াতে পারে। বারবার পেটের সমস্যা, আলসার, চর্মরোগ এসব সংকেতকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। শিশুদের বিকাশের সংবেদনশীল সময়ে বিষাক্ত উপাদান তাদের ভবিষ্যৎ সক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। এটা কোনো একক পরিবারের সমস্যা নয়; এটা জাতির সামগ্রিক ক্ষতি।
কেন এই চক্র চলতে থাকে
• লাভের লোভ: উৎপাদন ঘাটতি ও বেশি চাহিদার সুযোগে দ্রুত মুনাফার জন্য ভেজাল মিশ্রণ।
• তদারকির ঘাটতি: নিবন্ধন, মাননিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ শৃঙ্খলে দুর্বল নজরদারি।
• ভোক্তার আস্থার অপব্যবহার: ব্র্যান্ডের নাম, সিল ও প্যাকেট নকল করে প্রতারণা।
• জনসচেতনতার সীমাবদ্ধতা: চকচকে প্যাকেট, আকর্ষণীয় ডিজাইন ও অফারের ফাঁদে পড়া।
• দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তের স্বল্পতা: কঠোর শাস্তি ও ধারাবাহিক অভিযান না থাকলে অপরাধ প্রবণতা বাড়ে।
নীতি ও আইন প্রয়োগ
• শূন্য সহনশীলতা: ভেজাল খাদ্য প্রস্তুতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ও ধারাবাহিক অভিযান, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
• কঠোর লাইসেন্সিং: শিশু খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন, মান ও নিরাপত্তা পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা ও নিয়মিত অডিট।
• বিশেষ আদালত ও মোবাইল কোর্ট: ক্ষমতা, জনবল ও প্রযুক্তি সহায়তা বাড়িয়ে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা।
• বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ: চকচকে প্যাকেট, আকর্ষণীয় ডিজাইন ও বিভ্রান্তিমূলক অফার দিয়ে শিশুদের আকৃষ্ট করার কৌশল বন্ধ করা।
• বাজার তদারকি: সরবরাহ শৃঙ্খলের প্রতিটি ধাপে ট্রেসেবিলিটি ও হঠাৎ পরিদর্শন জোরদার করা।
জনসচেতনতা ও অংশীদারত্ব
• গণমাধ্যম প্রচারণা: তথ্যভিত্তিক ক্যাম্পেইন ভেজাল শনাক্তের কৌশল, অভিযোগ পদ্ধতি, আইনগত পরিণতি।
• শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠন: শিশুদের ও অভিভাবকদের জন্য নিয়মিত সচেতনতা সেশন, খাদ্য লেবেল পড়ার অনুশীলন।
• স্বাধীন মান যাচাই: শুধু ব্র্যান্ড নয়, তৃতীয়পক্ষ পরীক্ষার রিপোর্ট, ব্যাচ নম্বর ও উৎস যাচাইকে অভ্যাস করা।
অভিভাবকদের জন্য চেকলিস্ট
• লেবেল যাচাই: উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, নিবন্ধন/লাইসেন্স, ব্যাচ নম্বর, উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ।
• সতর্ক সংকেত: অস্বাভাবিক রঙ/গন্ধ, অতিরিক্ত মিষ্টতা/ঘনত্ব, প্যাকেটের বানানে ভুল, লোগো-সিলের অসামঞ্জস্য।
• বিশ্বস্ত উৎস: অনুমোদিত দোকান/চেইন, ঠান্ডা শৃঙ্খলা বজায় রাখা হয় এমন দোকান, রিটার্ন নীতিসহ রসিদ রাখা।
• বিকল্প অভ্যাস: স্থানীয় বিশ্বস্ত দুগ্ধ উৎস, বাড়িতে সাধারণ পরীক্ষা (পানিতে মিশিয়ে স্তর/গন্ধ দেখা), শিশুদের প্রক্রিয়াজাত খাবার কমানো।
• অভিযোগ করুন: সন্দেহ হলে দোকান, স্থানীয় প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখিত/ডিজিটালভাবে জানান, নীরবতা অপরাধকে শক্তিশালী করে।
• করণীয়: শূন্য সহনশীলতা থেকে পরিবারভিত্তিক সতর্কতা
দায়িত্ব সবার, প্রয়াসও সবার : শিশুরা বিষ নয়, পুষ্টির স্বাদ পাবে। এটা কোনো সৌজন্য প্রতিশ্রুতি নয়, এটা রাষ্ট্র ও সমাজের বাধ্যবাধকতা। কঠোর আইন প্রয়োগ, নীতিমালা উন্নয়ন, বাজার তদারকি এবং জনসচেতনতা চারটি চাকা একসাথে চললেই ভেজাল খাদ্যের চক্র ভাঙা সম্ভব। অভিভাবকদের ছোট ছোট সতর্কতা, ভোক্তার সাহসী অভিযোগ, মিডিয়ার ধারাবাহিক অনুসন্ধান আর প্রশাসনের দৃঢ়তা। এগুলোই বিষমুক্ত শৈশবের গ্যারান্টি। সুস্থ প্রজন্ম চাইলে ভেজাল দুধ ও দুধজাত খাবারের ঝকঝকে প্রতারণা থেকে দূরে থাকতে হবে, এবং সত্যিকারের নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থার জন্য একযোগে কাজ করতে হবে
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সংগঠক।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন